গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জেলা। শিল্প বাণিজ্য, প্রকৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির এ অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে এ জেলায়। খুলনায় রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যমন্ডিত বহু স্থান। তাই ভ্রমণপিপাসু, জ্ঞানপিপাসু এবং সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের জন্য খুলনা জেলা এক আকর্ষণীয় জেলা। সাজানো-গোছানো, প্রাকৃতিক আবহ, সংস্কৃতি ও বসবাসের উত্তম এই জেলাটি। এ জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই মনোমুগ্ধকর যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
খুলনার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই মনোমুগ্ধকর যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

১. হিরণ পয়েন্ট

হিরণ পয়েন্ট পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লোনা পানির বনাঞ্চল সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এর অন্য নাম নীলকমল। ইউনেস্কো ঘোষিত হিরণ পয়েন্টে অন্যতম বিশ্ব ঐতিহ্য। অভয়ারণ্য হওয়ার কারণে হিরণ পয়েন্ট অনেক বানর, হরিণ, বাঘসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ ও পাখির নিরাপদ প্রাকৃতিক আবাসস্থল। ফলে এখানে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণসহ সাদা বুক মাছরাঙা, হলুদ বুক মাছরাঙা, কালোমাথা মাছরাঙা, লার্জ এগ্রেট, কাঁদা খোঁচা, ধ্যানী বক প্রভৃতি পশুপাখির দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া এখানে আছে প্রচুর কাঁকড়া আর রঙ-বেরঙের প্রজাপতি।

এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা হিরণ পয়েন্টে কাঠের তৈরি সুন্দর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হরিণ, বানর, গুঁইসাপ, কুমির প্রভৃতি প্রাণীর দেখা পান। এছাড়া হিরণ পয়েন্ট থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে কেওড়াসুঠি নামক স্থানে হিরণ পয়েন্টসহ সুন্দরবনের একাংশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

২. করমজল পর্যটন কেন্দ্র

করমজল পর্যটন কেন্দ্র সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ৩০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, রেসাস বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল এবং টাওয়ার। জেলেদের মাছ ধরার কর্মযজ্ঞ এই পর্যটন কেন্দ্রে অতিরিক্ত প্রাপ্তি। এখানে বানর, হাতি, শেয়াল, কুমিরসহ অন্যান্য পশুপাখিরও দেখা মিলে। এখানে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হরিণ প্রজনন কেন্দ্র এবং ইকো ট্যুরিজম অবস্থিত।

করমজল পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ করতেই ঘন বনের পথে আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে এক ট্রেইল। এটি মাঙ্কি ট্রেইল নামে পরিচিত। এই ট্রেইলে হাঁটার সময় রেসাস বানরের দেখা মিলবে। হাঁটতে হাঁটতে সামনে গেলে হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রও দেখতে পাবেন। কাঠের ট্রেইলের পথের দুধারে রয়েছে কড়ই ও বাইন গাছ। ট্রেইল দিয়ে হেঁটে সামনে আগালে পশুর নদীর তীরে দেখতে পাবেন বেঞ্চ পাতানো ছাউনি। ট্রেইলের মূল অংশ গিয়ে থেমেছে একটি খালের পাড়ে। ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার যা থেকে পুরো পরিবেশটাকে ভালোভাবে দেখা যায়। করমজলের ট্রেইল ধরে সামনে আগালে চোখে পড়বে চিড়িয়াখানার মতো খাঁচায় ঘেরা খোলা জায়গা।

৩. পুটনি দ্বীপ

খুলনা জেলার নৈসর্গিক প্রকৃতির শোভা সুন্দরবনে অবস্থিত একটি দ্বীপের নাম হলো এই পুটনী দ্বীপ বা পুটনি আইল্যান্ড। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই দ্বীপের অন্য নাম দ্বীপচর। একপাশে দিগন্ত জোড়া সমুদ্র ও অন্যপাশে ঘন বনাঞ্চল এরই মধ্য দিয়ে রয়েছে সবুজ ঘাসের প্রান্তর ও আঁকাবাঁকা খাল। এক কথায় পুটনি আইল্যান্ড এক অপূর্ব স্থান। জোয়ার ভাটার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা একেবারে ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং আরেকবার অন্যরূপে দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। শেষ বিকেলের সূর্য এখানে অস্ত যায় আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায়।

হরিণ ও মাছের অভয়ারণ্য হওয়ার কারণে পুটনি দ্বীপে জেলে এবং সাধারণ মানুষের তেমন একটা আনাগোনা নেই। তবে আশেপাশের স্থানীয় অনেকেই কাঁকড়া আহরণ করতে পুটনি আইল্যান্ডে আসেন মাঝে মধ্যেই। এই দ্বীপের জঙ্গল এবং খালে হরিণ ও মাছের বিচরণ থাকলেও জানা যায় এখানে কোনো বাঘের উপদ্রবই নেই। তাই আপনি চাইলে বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে ঘুরতে আসতে পারেন প্রকৃতিতে ঘেরা এবং সৌন্দর্যে ঘেরা এই দ্বীপে।

৪. কটকা সমুদ্র সৈকত

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা খুলনার কয়রা উপজেলার কয়রা ইউনিয়নের একটি উপকূলবর্তী এলাকা কটকা। সুন্দরবনের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকতটি সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণগুলোর একটি। মোংলা বন্দর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা কটকা অভয়ারণ্য সুন্দরবন ইকো-ট্যুরিজমের প্রাণকেন্দ্র। কটকার সমুদ্র সৈকত কটকাবাসীদের কাছে জামতলা সমুদ্র সৈকত নামেই অধিক পরিচিত।

সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু বনে বাঘের দেখা মেলা যেমন ভার, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবে বাঘের দেখা পাওয়া ও নিরাপদে থাকা দুই-ই সম্ভব সুন্দরবনের চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র কটকা অভয়ারণ্য থেকে। এখানে প্রায়ই দেখা মেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। এছাড়া মনোরম চিত্রা হরিণের দল, বিভিন্ন জাতের পাখি, শান্ত প্রকৃতি এবং বিভিন্ন বন্য প্রাণীর উপস্থিতি এসবই এ স্থানটিকে অসাধারণ সৌন্দর্য দিয়ে ভরে দিয়েছে।

৫. শেখ রাসেল ইকো পার্ক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি শেখ রাসেল ইকো পার্ক। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মাথাভাঙ্গা মৌজায় এ পার্কটি অবস্থিত। সুন্দরবনের আদলে তৈরি করা হয়েছে পার্কটি। শহরের কোলাহল ও যান্ত্রিকতা ছেড়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া যায় পার্কটিতে। এখানে প্রবেশ করতেই একজন পর্যটক হারিয়ে যাবেন ছায়াশীতল মনোরম পরিবেশে।

পার্কটিতে গেলেই দেখা মিলবে পাখির অভয়ারণ্য, উপকূলবর্তী সুন্দরবনের গাছপালাসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির গাছ। খুলনা শহর থেকে রূপসা সেতুর পশ্চিম পাড়ের রাস্তা দিয়ে মাথাভাঙ্গা এলাকায় গেলেই পাওয়া যাবে শেখ রাসেল ইকো পার্ক। সড়ক পথে যেকোনো যানবাহনেই এ পার্কে যাওয়া যায়। এছাড়া নৌ পথেও রূপসা নদী হয়ে পার্কে যাওয়া যায়।

৬. দক্ষিণডিহি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্থান দক্ষিণডিহি। ফুল, ফল আর বিচিত্র গাছ গাছালিতে ঠাসা-সৌম্য-শান্তগ্রাম দক্ষিণডিহি। খুলনা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গেলে দক্ষিণ ডিহিগ্রাম। গ্রামের ঠিক মধ্য খানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য একটি দোতলা ভবন। এটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন এ দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এ গ্রামের-ই মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দক্ষিণ ডিহির মেয়ে। তার ভালো নাম ভবতারিণী, বিয়ের পর তার নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। এখানে কবিগুরু ও কবিপত্নীর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ২৫ বৈশাখ এবং ২২ শ্রাবণে এখানে নানা আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তী ও কবিপ্রয়াণ দিবস পালন করা হয়। খুলনা থেকে বাসে ফুলতলা উপজেলায় গিয়ে, সেখান থেকে অটোরিকশায় কিংবা স্থানীয় বাহনে যাওয়া যায় দক্ষিণডিহি।

৭. ভূতিয়ার পদ্মবিল
খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার ভূতিয়ার পদ্মবিল অবস্থিত। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এই পদ্মবিল যেন এক স্বর্গরাজ্য। হাজার হাজার পদ্ম ফোটে থাকে সমগ্র বিল জুড়ে। মোহনীয় এ দৃশ্য কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ঘুচাতে কাজ করে ম্যাজিকের মতো। ভূতিয়ার পদ্মবিল আবহমান গ্রাম বাংলার অপরূপ প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি, যা আগের মতো আর সবখানে দেখা যায়।

সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পদ্ম ফুল দেখতে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ বেলা যতই বাড়তে থাকে পদ্ম ফুলের ততই পাপড়ি বুজে যেতে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস ভূতিয়ার পদ্মবিল ভ্রমণের সবচেয়ে আদর্শ সময়।

৮. ভূতের আড্ডা

বটিয়াঘাটার মাথাভাঙ্গা এলাকায় রূপসা রিভার পার্ক অ্যান্ড ভূতের আড্ডা অবস্থিত। যেখানে রয়েছে ভূতের আকৃতির সঙ্গে আওয়াজ। পাশে কবুতর, তুত পাখি, চিনা হাঁস এবং বানর। পার্কের সব স্থানে কিছুক্ষণ পর পর দেখা মেলে চার ফুট লম্বা বাঘের ড্রেসে মুখোশধারী ভূতের।

খুলনা শহর থেকে রূপসা সেতুর পশ্চিম পাড়ের রাস্তা দিয়ে মাথাভাঙ্গা এলাকায় গেলেই পাওয়া যাবে ভূতের আড্ডা। সড়ক পথে যেকোনো যানবাহনেই এ পার্কে যাওয়া যায়। এছাড়া নৌ পথেও রূপসা নদী হয়ে ভূতের আড্ডায় যাওয়া যায়।

৯. বনবিলাস চিড়িয়াখানা

খানজাহান আলী থানাধীন জাহানাবাদ বনবিলাস চিড়িয়াখানার চারদিকে সবুজে অপূর্ব সমারোহ, পুরোপ্রাচীর এলাকাটি আধুনিক বনজ ইউক্যালিপটাসে ঘেরা। বলা যায় এক অনন্য দর্শনীয় স্থান। আয়তনে খুব বেশি বড় না হলেও বিচিত্র জীব-জন্তুর সমাবেশ এ চিড়িয়াখানায় রয়েছে। খুলনা-যশোর মহাসড়কের গিলাতলা নামক স্থানে অবস্থিত বনবিলাস চিড়িয়াখানা।

সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বনবিলাস চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত। বনবিলাস চিড়িয়াখানার চারপাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে লেক, বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে নৌকা ভ্রমণ। খুলনা-যশোর মহাসড়কের যেকোনো যানবাহনে করে গিলাতলা নামক স্থানে গেলেই পাওয়া যাবে বনবিলাস চিড়িয়াখানা।