জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ ডিসেম্বর ৪, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 1609 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সেই প্রেক্ষিতে নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থায় সর্বাত্মক সংস্কার করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ জন্য সময় লাগবে- সে কথাও বলেন ড. ইউনূস।
নিক্কেই এশিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি গত ৩০ নভেম্বর নেওয়া হয় আর প্রকাশিত হয় সোমবার।
নির্বাচনি ব্যবস্থা, সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জানুয়ারির মধ্যে ওই কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে।
তবে “এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে, কেননা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে আমরা একদম শূন্য থেকে শুরু করেছি।” বলেন ড. ইউনূস।
নির্বাচন ঠিক কখন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময় নির্ভর করছে সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর। এর ফলাফলই সময় নির্ধারণ করে দেবে।”
জাতীয় নির্বাচনে ড. ইউনূস প্রার্থী হবেন কি না জানতে চাইলে বিষয়টি নাকচ করে দেন নোবেল বিজয়ী এই অর্থননীতিবিদ। বলেন, “আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি সবসময়ই রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি।”
এসময় ‘রাষ্ট্রের যেসব ব্যক্তি নীতি-নৈতিকতা সমুন্নত রাখেন, নিয়ম-কানুন মেনে চলেন এবং নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখেন তাদের নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত বলে’ মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস।
বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের শাসনকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, আর গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করে তা পুনর্গঠনের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে।”
‘হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের রীতি-নীতি একদম ধ্বংস হয়ে গেছে’ মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “টানা তিন মেয়াদে ভোটারবিহীন ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা। আর তাতে তিনি নিজেকে এবং তার দলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।”
“একজন ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে এসব করেছেন হাসিনা”- বলেন ড. ইউনূস।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পতনের প্রসঙ্গ তুলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ বছরের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েকশ শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপরই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হাসিনার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান।”
এসময় ‘অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা এবং তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে” বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, “এই বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় হলে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারতকে অবহিত করা হবে।”
তিনি বলেন, “বিচার শেষে বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় এলে আমরা ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানাব।”
এক্ষেত্রে উভয় দেশের স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক আইনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। “ভারত এ আইন মেনে কাজ করতে বাধ্য হবে”- বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।
কূটনৈতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব করেছেন ড. ইউনূস। ভারত ও পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের ফলে সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। সার্কের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মতো নিজেদের মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য উৎসাহিত করা। সার্কের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
এদিকে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে ‘হামলা’ করা হয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। এ বিষয়ে ঢাকাকে অবশ্যই হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দিয়েছে দিল্লি। তবে ভারত সরকারের এসব ঢালাও বক্তব্য নাকচ করে দেন ড. ইউনূস। বলেন, ‘সংখ্যালঘু ইস্যুতে যা বলা হচ্ছে তার বেশির ভাগই প্রপাগান্ডা। এগুলো সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে না।”
এ বিষয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে তদন্তসাপেক্ষে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বানও জানান ড. ইউনূস। বলেন, “আমরা এসব অপতথ্যের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য কাজ করছি।”
অন্য আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ড. ইউনূস চীনকে ‘আমাদের বন্ধু’ বলে অভিহিত করে বলেন, “সড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে।”
“বাংলাদেশও বেইজিংয়ের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে” বলে জানান তিনি।
ড. ইউনূস দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার বিষয়ে জোর দেন।
আগামী জানুয়ারি মাস থেকে আসিয়ানের সভাপতি হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। ড. ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানান। তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানে স্বাগত জানাতে তার সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু ধাপ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, “আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপটি হবে আসিয়ানের সংজ্ঞা সংশোধনে একটি সর্বসম্মত রেজোল্যুশন নিশ্চিত করা। এর আগে আমরা আসিয়ানের একটি সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের আশা করছি।”
তিনি আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উঠলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই দায় (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ কতদিন বহন করবে? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমাদের একটি সুস্পষ্ট গন্তব্য ও একটি অভিন্ন লক্ষ্য ঠিক করা দরকার।”
বাংলাদেশ মিয়ানমারে জাতিসংঘ-শাসিত একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। বলেন, “এতে করে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের দেশেই আশ্রয়-শিবিরে থাকতে পারবে। সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তাদের অন্য কোনো দেশে স্থানাস্তর করার প্রয়োজন হবে না, তারা তাদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারবে।”