গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : বিভিন্ন সময় দুই দেশের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। গত সোমবার ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্য মোহাম্মদ রইশুদ্দীন। ঘটনার পর বিজিবি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে বিএসএফের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পতাকা বৈঠক করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয় বিজিবির পক্ষ থেকে। এ নিয়ে আলোচনা উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলেও।

এর আগেও বাংলাদেশের ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ সীমান্তের কাটাতারে ঝুলে থাকার ছবি বিশ^বিবেককে নাড়া দিলেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। সীমান্ত হত্যা নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৪৫ জন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটলেও একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। এই বিচারহীনতাই সীমান্ত হত্যাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে, যা বিশে^ পঞ্চম বৃহত্তম। এ ধরনের সীমান্ত হত্যাকান্ড শূণ্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি দেন। এরপরও থামেনি সীমান্ত হত্যা।

বেনাপোল সীমান্ত এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চোরাকারবারীরা সকলকে গোপনে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন কাউকে দেখা মাত্রই গুলি ছোড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। অনেক সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশও নিয়ে যায় তারা। তবে প্রতিটি সীমান্ত এলাকাতেই রয়েছে কিছু দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সকল অপকর্ম।

এদিকে নিরপরাধ লোকদের লক্ষ্য করেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গুলি ছুড়ে থাকেন। এমনকি অপহরণের ঘটনাও ঘটে কখনো কখনো।

সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি বিজিবি সদস্য হত্যার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র- আসকের তথ্য বলছে, গত বছর সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন ২৮ বাংলাদেশি। এর মধ্যে খুলনায় ৬ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, সিলেটে ৪ জন এবং রংপুরে ১৩ জন। সীমান্তে হত্যার পাশাপাশি নারকীয় নির্যাতনের কথাও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময় ঘটেছে।

এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ভারতের সদিচ্ছার অভাবেই সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন কমছে না। বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনীর হাতে কিন্তু কখনো ভারতীয় সীমান্তবাহিনি কিংবা সাধারণ ভারতীয়রা নির্যাতিত হয় না, হত্যার শিকার হয় না। বরং ভারতীয় বিএসএফ এর দ্বারাই বাঙালিরা হত্যার শিকার হয়, নির্যাতিত হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দুর্বল তাই আমরা ভারতকে এই হত্যা বা নির্যাতন বন্ধে কঠোর বার্তা দিতে পারছি না। এছাড়াও আমাদের দেশ ভারতের বেশি তাবেদারি করে তাই তারা কখনোই আমাদের তেমন গুরুত্ব দেয় না।

ফারুখ ফয়সাল আরও বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশকেও আরও সতর্ক হতে হবে। দেশে চোরাচালান ও মাদক পাচার বন্ধে কঠোর হতে হবে। বিএসএফ এর গুলিতে বিজিবির সদস্য নিহতের ঘটনায় সরকারের কঠোর ভূমিকা দরকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কয়েক বছর ধরেই ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে যাতায়াত পথে রয়েছে কড়া পাহাড়া। বৈধভাবে প্রতিদিনই পারাপার হচ্ছেন মানুষ। ব্যবসায়িক কাজসহ নানা প্রয়োজনে দুই দেশের মানুষ সম্পর্কযুক্ত। এমনকি আত্মীয়তার বন্ধনেও যেন আবদ্ধ হয়ে আছে অনেকে। তবে এরইমধ্যে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে চলে আসছে কিছু অপরাধী চক্রের নানাবিধ কর্মকাণ্ড। গোপনে ও প্রকাশ্যে অনেককেই ম্যানেজ করে দুই দেশের সীমান্তে চোরাকারবারীরা যেন ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে আছে। অবৈধভাবেই ওপার (ভারত) থেকে এপার আসছে নানা পণ্য। অনেকেই আবার মাদকসহ চোরাইপথে গরু আনা-নেওয়ার কাজেও ব্যস্ত। প্রাথমিকভাবে চোরাকারবার ও মাদক পাচার হচ্ছে সীমান্ত হত্যার মূল কারণ।

২০১৪ সালে ভারত থেকে গরু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর থেকে মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠে বাংলাদেশ। দেশের খামারিরাও ন্যায্য দাম পেয়ে হয়ে ওঠে সফল ব্যবসায়ী। ২০১৩ সালের ঈদুল আযহার সময় ভারত থেকে বাংলাদেশে ২৩ লাখ গরু আনা হয়েছে, যা ২০১৯ সালে নেমে এসেছে ৯৩ হাজারে। এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরে যে পরিমাণ গরুর চাহিদা রয়েছে তা পূরণে বাংলাদেশের খামারের গরুই যথেষ্ঠ। তবুও সীমান্ত দিয়ে এখনো প্রায়ই চোরাই গরু আসছে বলে তথ্য রয়েছে।

দেশের বেশিরভাগ গরুর হাটেই দেখা মেলে ভারতীয় নানা প্রজাতির গরু। তাহলে এই গরু আসলো কোথা থেকে। দুই দেশের কড়া নিরাপত্তার মধ্য থেকেও কীভাবে ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ করে তা একটি বড় প্রশ্ন। এদিকে ভারত থেকে নিয়মিতই আসছে ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক। প্রায় সময় বিজিবির অভিযানে সীমান্ত এলাকায় উদ্ধার হচ্ছে অসংখ্য মাদকদ্রব্য। তবে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বেশি আলামত মেলে গরু চোরাকারবারি নিয়ে। এপর্যন্ত সীমান্তে যত বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার বেশির ভাগই গরু চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত।

প্রতি বছরই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছে অসংখ্য বাংলাদেশি নাগরিক। তবে আশ্বাসের বাণী শোনালেও এখন পর্যন্ত এর কোনোটির বিচার হয়নি। ২০১১ সালে সীমান্তে ফেলানি হত্যার নির্মম ঘটনা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে। এর বছর ছয়েক পরে ২০১৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে তেমন রূপ নেয়নি বললেই চলে। ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে বিএসএফ সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনাকে বলছে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।

২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। এর আগের দিন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে দুইজন ও ৮ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে দুই যুবক বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হয়।

২০১৫-২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আসকের হিসাবে ২৪৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন এবং ২০২৩ সালে ৩০ জন। আর সর্বশেষ চলতি বছরে প্রথম সীমান্ত হত্যার শিকার হলেন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীরই একজন সদস্য। এমনকি বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাসেই চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে ৭ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে।

এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ১০ বছরে ২৯৪ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছিলেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ওরা (ভারত) বারবারই আমাদের আশ্বাস দেয় সীমান্তে কোনো নির্যাতন বা হত্যার ঘটনা ঘটবে না। বারবারই দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের তরফ থেকে বলা হয় সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে এবং হাঁটুর নিচে গুলি করার কথা। এ ব্যাখ্যাটাও দেওয়া হয় সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমিয়ে আনার, কমিয়ে আনা তো কোনো কথা হতে পারে না, এটাকে জিরো পয়েন্টে আনতে হবে। সীমান্তে হত্যা জিরোপয়েন্টে আনতে আমাদের জোড় দিয়ে বিষয়টি তুলতে হবে। সীমান্তে হত্যার ঘটনা যেন জিরো পয়েন্টে আসে।

তিনি বলেন, যদি আমরা ধরেও নেই, সীমান্ত দিয়ে পাচার হছে, চোরাচালান হচ্ছে, কিন্তু সেটারও তো একটা আইন আছে, বিচারের আওতায় না এনে তো একটা মানুষকে মারা যাবে না। সীমান্তে হত্যার বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কোনো বিষয় বা ঘাটতির কোনো বিষয় নেই। তাদের (ভারত) দেশের বিএসএফের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোড়ালো পদক্ষেপ দরকার। আর সেই বিষয়ে আমাদের দেশের তরফ থেকে তাদের তাগিদ দিতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, কোনো মানুষকে হত্যা বা গুলি করে হত্যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্তে কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে না। প্রতিবারই আমরা আশার বাণি শুনি, পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরগুলোতে তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। দুই দেশেই আইন আছে, তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। সুত্র : ঢাকা টাইমস।