০৭:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

ভারতের বেপরোয়া চাপ : নিরাপত্তা ইস্যুতে মতপার্থক্য : সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত : অদৃশ্য সংকটে অন্তর্বর্তী সরকার

নিউজ ডেস্ক

॥ ফারাহ মাসুম॥
নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জটিল এবং অস্থির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জসহ বেশকিছু বিষয় দেশের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এক অদৃশ্য সংকটে পড়েছে।

রাজনীতিতে কী ঘটছে : ২০২৪ সালের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বাংলাদেশ এক অস্থির রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সাফল্যের পরও প্রতিপক্ষ শক্তি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী এবং ভিন্নমত দমনের জন্য নেয়া মর্মে সমালোচনা করছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা এবং দেড় দশক ধরে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমের অভিযোগে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সম্পর্কিত গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের গণহত্যার অভিযোগের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির অঙ্গ সংগঠনসহ সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। এর ফলে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপের সমালোচনা করে সরকারের ওপর নানা কৌশলে চাপ প্রয়োগ করছে। তারা যুক্তি দেখাচ্ছে, এ নিষেধাজ্ঞা পূর্ববর্তী সরকারের দমনমূলক কৌশলের প্রতিফলন এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ক্ষুণ্ন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাংবাদিকরা ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন বলেও প্রচার চালানো হচ্ছে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত পতিত ফ্যাসিবাদের মতো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেনি। গণহত্যার ইন্ধন দেয়ার জন্য অভিযুক্ত সাংবাদিকদের গ্রেফতার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুকূল বিষয়বস্তু প্রকাশে বিধিনিষেধকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবক্ষয় হিসেবে তুলে ধরে এর সমালোচনা করছে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা।
অস্থিরতার মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার

রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। এ চুক্তিতে আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বৃহত্তর বিনিময় হার নমনীয়তা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুনর্গঠনের মতো সংস্কার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ফ্যাসিবাদের আমলে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে নেয়ার পরও সরকার ব্যাংক খাতে সচল অবস্থা ধরে রেখেছে। ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের কারণে সিন্ডিকেট করে পাচারকারীরা তাদের লুটে নেয়া অর্থ দেশে-বিদেশে লবি করার কাজে ব্যয় করছে।

খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, যাকে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তার প্রত্যাবর্তনকে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সহজতর করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপ দেওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখা হয়।
বেগম খালেদা জিয়ার ওপর আগের ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যাপক নিপীড়ন চালায়। তাকে এতিমখানার অর্থ আত্মসাতের কল্পিত অভিযোগ এনে শাস্তি দিয়ে জেলবন্দী করে রাখা হয়। অসুস্থ হওয়ার পরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে না দিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে পঙ্গু অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এ জুলুমের শিকার হওয়ার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দেখা যায়।
ইসলামপন্থিদের সমর্থন বৃদ্ধি

বিএনপির পাশাপাশি দেশের ইসলামী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহের ওপর জঙ্গি-মৌলবাদসহ নানা ট্যাগ দিয়ে হত্যা, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নির্বিচারভাবে চালিয়ে যাবার কারণে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। এক জরিপ অনুসারে, তাদের জনসমর্থন একসময়ের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। দেশের মানুষ এখন ইসলামিক শক্তিকে রাষ্ট্র শাসনের জন্য বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে।
এদিকে ভারতীয় লবি বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামপন্থি দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিকে পশ্চিমের কাছে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে। বিতর্কিত নারীনীতি তৈরি করে তাদের অন্তর্বর্র্তী সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চাইছে। নারীনীতির বিরুদ্ধে ইসলামী নীতিগুলো পুনর্নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর দাবিতে ইসলামিক দলগুলো বৃহৎ সমাবেশ আয়োজন করেছে এবং সরকারের বিতর্কিত নারী অধিকার উদ্যোগের সমালোচনা করছে। এ ঘটনাগুলো দেশের রাজনীতিতে আরও রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রভাবের দিকে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তর্জাতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলেও প্রচার চালানো হচ্ছে। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করে ভারতীয় গণমাধ্যম এটিকে ফলাও করে প্রচার করছে। আর বাংলাদেশি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে নানা ধরনের সন্ত্রাসী হুমকির অভিযোগ তুলে ভারত সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের পুশইন করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী।

অর্জন এবং সমর্থন
আন্তর্জাতিক সমর্থন : ড. ইউনূস প্রশাসন ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহ যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করেছে। এ তহবিলের লক্ষ্য বিনিময় হারের নমনীয়তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের মতো সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। আইএমএফের এ সমর্থনকে সার্বিকভাবে পশ্চিমা সমর্থন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি : গত ২০ মে বাংলাদেশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অতীতে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে। স্টারলিংকের মালিক ট্রাম্প প্রশাসনের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা।

চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা
বিলম্বিত নির্বাচন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছে। তবে বিএনপির মতো বিরোধীদলগুলো ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাচ্ছে সতর্ক করে দিচ্ছে যে, বিলম্ব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট: সাবেক সরকারের সমর্থকদের লক্ষ করে দেশব্যাপী এ অভিযানে ১১,০০০ এরও বেশি গ্রেফতার করা হয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ভিন্নমত দমন এবং সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

দৃষ্টিভঙ্গিগত বিরোধ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন এবং সংস্কার শুরু করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করলেও, এর ভবিষ্যৎ নানা শক্তিশালী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্যে বেশকিছুটা অনিশ্চিত। বিলম্বিত নির্বাচন, বিরোধীদলের দমন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ এবং ক্রমবর্ধমান ইসলামিক প্রভাবের সমন্বয় এর বৈধতা এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে কোনো কোনো পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হচ্ছে।
গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য ড. ইউনূস প্রশাসনকে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে, গণতান্ত্রিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে হবে এবং সকল রাজনৈতিক অংশীদারদের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপে অংশগ্রহণ করতে হবে বলে তারা উল্লেখ করছে।
সন্ত্রাসী হুমকির প্রচারণা ভারতের

কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তানের কাছে মার খাবার পর বাংলাদেশে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থানের কল্পিত প্রচারণা চালিয়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে স্থল ও জল সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। বিএসএফ সুন্দরবন অঞ্চলে সাতটি নতুন ফাঁড়ি স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ পুলিশও তাদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করছে এবং ভারতীয় পরিচয়পত্রের ওপর কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বিএসএফের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন যে, এ পোস্টগুলো মূলত ভাসমান কাঠামো হবে, যা চ্যালেঞ্জিং ভূখণ্ডে নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ সপ্তাহের শুরুতে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে ভারতবিরোধী শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নয়াদিল্লি ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্র করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমরা নতুন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বৃদ্ধি লক্ষ করেছি; বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তরুণ নিয়োগকারীদের লক্ষ করে।’
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্রগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অনুপ্রবেশের জন্য জলপথ ব্যবহারের কথিত প্রোপাগান্ডাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে বর্ণনা করছে। এসব বয়ান বাংলাদেশের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব তৈরির জন্য করা হচ্ছে বলে এ সূত্র উল্লেখ করছে।
সুন্দরবনের প্রায় ১৫৭ কিমি উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ঘন ম্যানগ্রোভ বন সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করার যুক্তি দেখিয়ে ভারত এ অঞ্চলে বিএসএফের বর্ধিত উপস্থিতি, উন্নত নজরদারি সরঞ্জাম এবং বর্ধিত টহল ফ্রিকোয়েন্সি সৃষ্টি করতে চাইছে। নতুন আউটপোস্টগুলো বিদ্যমান পোস্টগুলোর মধ্যে ব্যবধান কমাবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ইউনূসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও ভারতীয় মিডিয়ায় উল্লেখ করা হচ্ছে। ফ্রান্সের নিসে আসন্ন জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের ইকোনমিক টাইমসসহ একাধিক গণমাধ্যমে।

এসব মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, ঢাকা এ বৈঠকের জন্য অনুরোধ করেছিল, কিন্তু ফ্রান্স সম্মেলন থেকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আলাদা রাখার অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করেছে। আগের হাসিনা সরকারের আমলে এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতির বিষয়টা আলোচনায় না থাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আগামী মাসে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
তৃতীয় জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনে যোগদানের জন্য ড. ইউনূস ফ্রান্স সফরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং ঢাকা সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস ও ম্যাক্রোঁর মধ্যে একটি বৈঠকের অনুরোধ করেছিল। তবে ফ্রান্স সেই বৈঠকের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় ইউনূস ফ্রান্স সফর বাতিল করেছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বন্দর ও করিডোর নিয়ে বিতর্ক
সম্প্রতি বাংলাদেশে দুটি উল্লেখযোগ্য বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এর একটি হলো- চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর জন্য একজন বিদেশি অপারেটর নিয়োগ এবং অন্যটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব।
এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক একটি সংস্থা ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিয়োগের জন্য হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি বন্দর শ্রমিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। বিএনপির সাথে যুক্ত জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সদস্যদের সাথে শ্রমিকরা এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন, চাকরি হারানোর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সম্পদের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে তাদের সামনে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এ নিয়োগকে সমর্থন করে যুক্তি দেয় যে, একজন বিদেশি অপারেটর দক্ষতা এবং রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারে। তবে ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই চুক্তি পেয়েছে, যার ফলে একচেটিয়া অনুশীলন এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব রাজনৈতিক ও জনসাধারণের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাখাইনে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের মধ্যে সাহায্য সরবরাহ সহজতর করার উদ্দেশ্যে তৈরি এ করিডোর জাতীয় সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করা এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংঘাতে টেনে আনার জন্য বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।
সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, নির্বাচনী ম্যান্ডেটের অভাব থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরামর্শ ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। উদ্বেগগুলো শরণার্থীপ্রবাহ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা করিডোরটি শোষণের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করেও কেন্দ্রীভূত।

যদিও সরকার স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি। প্রস্তাবটি এখনো বিতর্কিত বিষয়, যা মানবিক দায়িত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য তুলে ধরে।
রাজনৈতিক তদন্ত এবং জনসাধারণের উদ্বেগের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক মানবিক সংকট মোকাবিলা করার সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে, তা এ বিতর্কগুলো তুলে ধরে।

নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বিরোধ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে বিরোধ নিয়েও ভারতীয় পত্রপত্রিকার নানা খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। এসব অনির্ভরযোগ্য খবরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রাথমিকভাবে অধ্যাপক ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ দাবি করেছেন যে, সেনাপ্রধান প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস? অন্য কোনো ব্যক্তি কেন নয়?’

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়েও উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলে অধ্যাপক ইউনূস জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিদেশে থাকাকালীন খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এ সিদ্ধান্ত অসন্তোষের সৃষ্টি করে উল্লেখ করে বলা হয়, সেনাপ্রধানের সাথে পরামর্শ না করেই এ নিয়োগ করা হয়েছিল। ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এ পদক্ষেপ সামরিক বাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে আরও সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এর আগে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের প্রকাশ্য বিবৃতিতে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয় এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করতে পারে এমন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়। এ মন্তব্যগুলোকে কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক ভিন্নমত মোকাবিলার গোপন সমালোচনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনীর প্রভাব নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং সুশীল সমাজের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, নিয়োগ এবং নীতি নির্দেশনার মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

প্রফেসর ইউনূস এবং জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চিহ্নিত বলে মনে হচ্ছে। যদিও উভয় পক্ষই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের সাম্প্রতিক মতবিরোধ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ দ্বারা চিহ্নিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময়কে অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সাফল্য সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সেনাবাহিনীর কার্যকরভাবে সহযোগিতা করার, জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ১১:৫০:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

ভারতের বেপরোয়া চাপ : নিরাপত্তা ইস্যুতে মতপার্থক্য : সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত : অদৃশ্য সংকটে অন্তর্বর্তী সরকার

আপডেট: ১১:৫০:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

॥ ফারাহ মাসুম॥
নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জটিল এবং অস্থির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জসহ বেশকিছু বিষয় দেশের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এক অদৃশ্য সংকটে পড়েছে।

রাজনীতিতে কী ঘটছে : ২০২৪ সালের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বাংলাদেশ এক অস্থির রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সাফল্যের পরও প্রতিপক্ষ শক্তি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী এবং ভিন্নমত দমনের জন্য নেয়া মর্মে সমালোচনা করছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা এবং দেড় দশক ধরে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমের অভিযোগে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সম্পর্কিত গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের গণহত্যার অভিযোগের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির অঙ্গ সংগঠনসহ সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। এর ফলে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপের সমালোচনা করে সরকারের ওপর নানা কৌশলে চাপ প্রয়োগ করছে। তারা যুক্তি দেখাচ্ছে, এ নিষেধাজ্ঞা পূর্ববর্তী সরকারের দমনমূলক কৌশলের প্রতিফলন এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ক্ষুণ্ন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাংবাদিকরা ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন বলেও প্রচার চালানো হচ্ছে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত পতিত ফ্যাসিবাদের মতো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেনি। গণহত্যার ইন্ধন দেয়ার জন্য অভিযুক্ত সাংবাদিকদের গ্রেফতার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুকূল বিষয়বস্তু প্রকাশে বিধিনিষেধকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবক্ষয় হিসেবে তুলে ধরে এর সমালোচনা করছে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা।
অস্থিরতার মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার

রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। এ চুক্তিতে আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বৃহত্তর বিনিময় হার নমনীয়তা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুনর্গঠনের মতো সংস্কার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ফ্যাসিবাদের আমলে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে নেয়ার পরও সরকার ব্যাংক খাতে সচল অবস্থা ধরে রেখেছে। ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের কারণে সিন্ডিকেট করে পাচারকারীরা তাদের লুটে নেয়া অর্থ দেশে-বিদেশে লবি করার কাজে ব্যয় করছে।

খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, যাকে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তার প্রত্যাবর্তনকে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সহজতর করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপ দেওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখা হয়।
বেগম খালেদা জিয়ার ওপর আগের ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যাপক নিপীড়ন চালায়। তাকে এতিমখানার অর্থ আত্মসাতের কল্পিত অভিযোগ এনে শাস্তি দিয়ে জেলবন্দী করে রাখা হয়। অসুস্থ হওয়ার পরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে না দিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে পঙ্গু অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এ জুলুমের শিকার হওয়ার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দেখা যায়।
ইসলামপন্থিদের সমর্থন বৃদ্ধি

বিএনপির পাশাপাশি দেশের ইসলামী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহের ওপর জঙ্গি-মৌলবাদসহ নানা ট্যাগ দিয়ে হত্যা, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নির্বিচারভাবে চালিয়ে যাবার কারণে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। এক জরিপ অনুসারে, তাদের জনসমর্থন একসময়ের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। দেশের মানুষ এখন ইসলামিক শক্তিকে রাষ্ট্র শাসনের জন্য বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে।
এদিকে ভারতীয় লবি বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামপন্থি দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিকে পশ্চিমের কাছে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে। বিতর্কিত নারীনীতি তৈরি করে তাদের অন্তর্বর্র্তী সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চাইছে। নারীনীতির বিরুদ্ধে ইসলামী নীতিগুলো পুনর্নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর দাবিতে ইসলামিক দলগুলো বৃহৎ সমাবেশ আয়োজন করেছে এবং সরকারের বিতর্কিত নারী অধিকার উদ্যোগের সমালোচনা করছে। এ ঘটনাগুলো দেশের রাজনীতিতে আরও রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রভাবের দিকে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তর্জাতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলেও প্রচার চালানো হচ্ছে। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করে ভারতীয় গণমাধ্যম এটিকে ফলাও করে প্রচার করছে। আর বাংলাদেশি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে নানা ধরনের সন্ত্রাসী হুমকির অভিযোগ তুলে ভারত সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের পুশইন করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী।

অর্জন এবং সমর্থন
আন্তর্জাতিক সমর্থন : ড. ইউনূস প্রশাসন ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহ যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করেছে। এ তহবিলের লক্ষ্য বিনিময় হারের নমনীয়তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের মতো সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। আইএমএফের এ সমর্থনকে সার্বিকভাবে পশ্চিমা সমর্থন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি : গত ২০ মে বাংলাদেশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অতীতে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে। স্টারলিংকের মালিক ট্রাম্প প্রশাসনের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা।

চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা
বিলম্বিত নির্বাচন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছে। তবে বিএনপির মতো বিরোধীদলগুলো ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাচ্ছে সতর্ক করে দিচ্ছে যে, বিলম্ব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট: সাবেক সরকারের সমর্থকদের লক্ষ করে দেশব্যাপী এ অভিযানে ১১,০০০ এরও বেশি গ্রেফতার করা হয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ভিন্নমত দমন এবং সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

দৃষ্টিভঙ্গিগত বিরোধ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন এবং সংস্কার শুরু করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করলেও, এর ভবিষ্যৎ নানা শক্তিশালী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্যে বেশকিছুটা অনিশ্চিত। বিলম্বিত নির্বাচন, বিরোধীদলের দমন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ এবং ক্রমবর্ধমান ইসলামিক প্রভাবের সমন্বয় এর বৈধতা এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে কোনো কোনো পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হচ্ছে।
গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য ড. ইউনূস প্রশাসনকে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে, গণতান্ত্রিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে হবে এবং সকল রাজনৈতিক অংশীদারদের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপে অংশগ্রহণ করতে হবে বলে তারা উল্লেখ করছে।
সন্ত্রাসী হুমকির প্রচারণা ভারতের

কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তানের কাছে মার খাবার পর বাংলাদেশে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থানের কল্পিত প্রচারণা চালিয়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে স্থল ও জল সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। বিএসএফ সুন্দরবন অঞ্চলে সাতটি নতুন ফাঁড়ি স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ পুলিশও তাদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করছে এবং ভারতীয় পরিচয়পত্রের ওপর কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বিএসএফের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন যে, এ পোস্টগুলো মূলত ভাসমান কাঠামো হবে, যা চ্যালেঞ্জিং ভূখণ্ডে নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ সপ্তাহের শুরুতে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে ভারতবিরোধী শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নয়াদিল্লি ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্র করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমরা নতুন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বৃদ্ধি লক্ষ করেছি; বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তরুণ নিয়োগকারীদের লক্ষ করে।’
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্রগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অনুপ্রবেশের জন্য জলপথ ব্যবহারের কথিত প্রোপাগান্ডাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে বর্ণনা করছে। এসব বয়ান বাংলাদেশের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব তৈরির জন্য করা হচ্ছে বলে এ সূত্র উল্লেখ করছে।
সুন্দরবনের প্রায় ১৫৭ কিমি উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ঘন ম্যানগ্রোভ বন সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করার যুক্তি দেখিয়ে ভারত এ অঞ্চলে বিএসএফের বর্ধিত উপস্থিতি, উন্নত নজরদারি সরঞ্জাম এবং বর্ধিত টহল ফ্রিকোয়েন্সি সৃষ্টি করতে চাইছে। নতুন আউটপোস্টগুলো বিদ্যমান পোস্টগুলোর মধ্যে ব্যবধান কমাবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ইউনূসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও ভারতীয় মিডিয়ায় উল্লেখ করা হচ্ছে। ফ্রান্সের নিসে আসন্ন জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের ইকোনমিক টাইমসসহ একাধিক গণমাধ্যমে।

এসব মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, ঢাকা এ বৈঠকের জন্য অনুরোধ করেছিল, কিন্তু ফ্রান্স সম্মেলন থেকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আলাদা রাখার অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করেছে। আগের হাসিনা সরকারের আমলে এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতির বিষয়টা আলোচনায় না থাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আগামী মাসে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
তৃতীয় জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনে যোগদানের জন্য ড. ইউনূস ফ্রান্স সফরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং ঢাকা সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস ও ম্যাক্রোঁর মধ্যে একটি বৈঠকের অনুরোধ করেছিল। তবে ফ্রান্স সেই বৈঠকের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় ইউনূস ফ্রান্স সফর বাতিল করেছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বন্দর ও করিডোর নিয়ে বিতর্ক
সম্প্রতি বাংলাদেশে দুটি উল্লেখযোগ্য বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এর একটি হলো- চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর জন্য একজন বিদেশি অপারেটর নিয়োগ এবং অন্যটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব।
এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক একটি সংস্থা ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিয়োগের জন্য হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি বন্দর শ্রমিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। বিএনপির সাথে যুক্ত জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সদস্যদের সাথে শ্রমিকরা এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন, চাকরি হারানোর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সম্পদের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে তাদের সামনে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এ নিয়োগকে সমর্থন করে যুক্তি দেয় যে, একজন বিদেশি অপারেটর দক্ষতা এবং রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারে। তবে ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই চুক্তি পেয়েছে, যার ফলে একচেটিয়া অনুশীলন এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব রাজনৈতিক ও জনসাধারণের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাখাইনে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের মধ্যে সাহায্য সরবরাহ সহজতর করার উদ্দেশ্যে তৈরি এ করিডোর জাতীয় সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করা এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংঘাতে টেনে আনার জন্য বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।
সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, নির্বাচনী ম্যান্ডেটের অভাব থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরামর্শ ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। উদ্বেগগুলো শরণার্থীপ্রবাহ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা করিডোরটি শোষণের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করেও কেন্দ্রীভূত।

যদিও সরকার স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি। প্রস্তাবটি এখনো বিতর্কিত বিষয়, যা মানবিক দায়িত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য তুলে ধরে।
রাজনৈতিক তদন্ত এবং জনসাধারণের উদ্বেগের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক মানবিক সংকট মোকাবিলা করার সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে, তা এ বিতর্কগুলো তুলে ধরে।

নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বিরোধ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে বিরোধ নিয়েও ভারতীয় পত্রপত্রিকার নানা খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। এসব অনির্ভরযোগ্য খবরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রাথমিকভাবে অধ্যাপক ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ দাবি করেছেন যে, সেনাপ্রধান প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস? অন্য কোনো ব্যক্তি কেন নয়?’

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়েও উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলে অধ্যাপক ইউনূস জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিদেশে থাকাকালীন খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এ সিদ্ধান্ত অসন্তোষের সৃষ্টি করে উল্লেখ করে বলা হয়, সেনাপ্রধানের সাথে পরামর্শ না করেই এ নিয়োগ করা হয়েছিল। ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এ পদক্ষেপ সামরিক বাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে আরও সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এর আগে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের প্রকাশ্য বিবৃতিতে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয় এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করতে পারে এমন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়। এ মন্তব্যগুলোকে কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক ভিন্নমত মোকাবিলার গোপন সমালোচনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনীর প্রভাব নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং সুশীল সমাজের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, নিয়োগ এবং নীতি নির্দেশনার মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

প্রফেসর ইউনূস এবং জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চিহ্নিত বলে মনে হচ্ছে। যদিও উভয় পক্ষই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের সাম্প্রতিক মতবিরোধ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ দ্বারা চিহ্নিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময়কে অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সাফল্য সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সেনাবাহিনীর কার্যকরভাবে সহযোগিতা করার, জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে।