জেলা প্রতিনিধি, নড়াইল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার মোল্যাকে ‘বেদুইন সাত্তার’ উপাধি দেন। ১৯৭৩ সালে খুলনার সার্কিট হাউজ মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাকে এ নাম দেন।

মুজিবপ্রেমিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা জানতে পারেন। পরদিন পত্রিকায় খবর ছাপা হয়। তা থেকে তিনি সিঁড়িতে খালি পায়ে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পড়ে থাকার খবর জানতে পারেন। এটি জেনে প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর কখনো জুতা পায়ে দেবেন না। যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনই কাজ। এরপর থেকে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতেন বেদুইন সাত্তার। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে ৩৫ বছর পরে স্যান্ডেল পায়ে দেন এই বঙ্গবন্ধু ভক্ত।

মুজিবপ্রেমিক আব্দুস সাত্তার মোল্যা অর্থাৎ বেদুইন সাত্তারের বয়স এখন প্রায় ৯৬ বছর। নানা সংগ্রাম আর প্রতিবাদের মধ্যে কাটানো সাত্তার মোল্যা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে অনেকটা স্মৃতিশক্তিহীন। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বেদুইন উপাধি নিয়ে আজও চারিদিকে বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজে বেড়ান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। একা চলতে পারেন না। হুইল চেয়ারে বসে কখনো ছেলে, কখনো ছেলের বৌয়ের হাত ধরে ঘরের বাইরে যান তিনি। স্মৃতিতে সবই আছে, কিন্তু বয়সের ভারে কথাবার্তা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে।

জানা গেছে, তৎকালীন নড়াইল মহকুমার বিষ্ণুপুর গ্রামের ব্রিটিশ আন্দোলনের নেতা নোয়াই মোল্যার ছেলে আব্দুস সাত্তার মোল্যা। তিনি ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে যান। ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে নড়াইল সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই যেখানেই বঙ্গবন্ধুর সভা সেখানেই ছুটে যেতেন তিনি। সেটি খুলনা হোক অথবা চট্টগ্রাম, কিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারতো না।

বঙ্গবন্ধুর বেদুইন সাত্তার নড়াইলের নিভৃত একজন রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। ঘরে ঢুকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে আপন ছোটভাই গোলাম সরোয়ারকে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন বড়ভাই জাফর আহম্মেদ। কিন্তু তখন তিনি বাড়িতে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। পরে পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করতেন তিনি।

বাঁশগ্রাম গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আজিবর রহমান বলেন, আমার পাশের গ্রামের আব্দুস সাত্তার মোল্যা আগরতলা মামলার সময় আমাদের এলাকা থেকে চাঁদা তুলে তা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুবই স্নেহ করতেন। খুলনায় এক জনসভায় তার নাম দিয়েছিলেন বেদুইন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তিনি খালি পায়ে হেঁটেছেন বহুদিন।

বেদুইন সাত্তারের বড় ছেলে সুজাউদ্দৌলা বলেন, মা আমার নাম রেখেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। আব্বার কাছে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু নড়াইল এক সভায় এসে আমাকে দেখেছিলেন। আমার মায়ের নাম মমতাজ জেনে সম্রাট শাহজাহানের ছেলের নামে আমার নাম রাখেন সুজাউদ্দৌলা।

বেদুইন সাত্তারের সেজো ছেলে চাচুড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হীরক জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬ সালে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আমার পরিচয় দিই। তিনি তাৎক্ষণিক বাবার খোঁজ-খবর নেন। বাবাকে তিনি ছোটবেলা থেকেই চিনতেন জানিয়ে বলেন, চাচাকে আমার জন্য দোয়া করতে বলবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বাবার জন্য কিছু উপহার দেন আমার কাছে।

নড়াইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মো. গোলাম কবীর জাগো নিউজকে, সাত্তার ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন সহচর। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তিনি বহুদিন জুতা পায়ে দেননি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের ত্যাগী, আত্মপ্রত্যয়ী মুজিবপ্রেমিক নড়াইলে তথা দেশে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আমরা সর্বদা তার খোঁজ-খবর রাখছি। সুত্র: জাগো নিউজ।