নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনাসহ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিএনপি। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণার আট দিনের মাথায় সংক্ষিপ্ত এ রূপরেখা দিল দলটি।

ঢাকার গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে সোমবার বিকালে আয়োজিত বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দেশবাসীর সামনে এ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এসময় যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন গড়তে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপ করে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়।

রূপরেখায় বিএনপি বলেছে, বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এ রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে। আর সেই জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন।

নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই জাতীয় সরকার সংস্কারমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে।

বিশেষ এই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দীন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, নিতাই রায় চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, হাবিবুর রহমান হাবিব, কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মাহবুবে রহমান শামীম, বিলকিস জাহান শিরিন, শ্যামা ওবায়েদ, অনিন্দ্র ইসলাম অমিত, আসাদুজ্জামান, জহির উদ্দিন স্বপন, শাম্মী আখতার, বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খান প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ঐকমত্য পোষণকারী সমমনা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে গণফোরামের মোস্তফা মোহসিন মন্টু, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, জেএসডির শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, ২০ দলীয় জোটের জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা কামরুল খান, জাগপার ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান, জাগপার অপর অংশের খন্দকার লুৎফর রহমান, ন্যাপ-ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, ডিএলের সাইফুদ্দিন মনি, মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, বাংলাদেশ ন্যাপের শাওন সাদেকী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পেশাজীবীদের মধ্যে অধ্যাপক আফম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক তাজমেরি এস এ ইসলাম, অধ্যাপক একেএম আজিজুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুল আলম, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, কাদের গনি চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখায় যা আছে:

১. একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বর্তমান অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত/সংশোধন করা হবে।

২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক “Rainbow Nation” প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য একটি “National Reconciliation Commission” গঠন করা হবে।

৩. একটি “নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।

৪. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন করা হবে।

৫. পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

৬. বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে “উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা” (Upper House of the Legislature) প্রবর্তন করা হবে।

৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে।

৮. বর্তমান “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২” সংশোধন করা হবে।

৯. সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ডেটিং সাপেক্ষে এই সকল প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা হবে।

১০. বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি “জুডিশিয়াল কমিশন” গঠন করা হবে।

১১. একটি “প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন” গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে।

১২. মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি “মিডিয়া কমিশন” গঠন করা হবে।

১৩. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোন আপস করা হবে না। অর্থ-পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী “ন্যায়পাল (Ombudsman)” নিয়োগ করা হবে।

১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। Universal Human Rights Charter অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে।

১৫. বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি “অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন” গঠন করা হবে।

১৬. “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার” এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন।

১৭. মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে।

১৮. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে।

১৯. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে।

২০. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে।

২১. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে।

২২. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাঁদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।

২৩. যুবসমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা করা হবে।

২৪. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।

২৫. চাহিদা-ভিত্তিক (Need-based) ও জ্ঞান-ভিত্তিক (Knowledge-based) শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

২৬. “সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘NHS” এর আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে।

২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে।

পরবর্তীতে যথাসময়ে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব ও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছে বিএনপি।