নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের প্রত্যেকটি গুমের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।

বুধবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।

রিজভী বলেন, “এক সময়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য স্বৈরাচারবিরোধী সাহসী কণ্ঠস্বর এম ইলিয়াস আলীর গুমের আজ ১২ বছর পূর্ণ হলো। তাকে ফিরে পাওয়ার অধীর অপেক্ষায় আজও প্রহর গুনছেন তার স্ত্রী-সন্তান-পরিবারসহ দেশের অগণিত নেতাকর্মী। শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গাড়িচালক আনসার আলীসহ তুলে নিয়ে যায় ইলিয়াস আলীকে। এরপর গাড়িটি পাওয়া গেলেও হদিস মেলেনি তাদের। একথা আজ জনগণের সামনে স্পষ্ট যে, এই ফ্যাসিবাদী সরকারই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম আর টিপাইমুখ বাঁধ ও সীমান্ত আগ্রাসনের প্রতিবাদে সিলেট অঞ্চলে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে নেতৃত্বের কারণে ইলিয়াস আলী রাষ্ট্রযন্ত্র ও দেশি-বিদেশি অপশক্তির গাত্রদাহের প্রধান কারণ ছিল। ইলিয়াস আলী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় ঈর্ষান্বিত সরকার রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তাকে গুম করে রেখেছে। ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর সরকার বহুবিধ নাটক সাজিয়েছে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে অশোভন কথা লিখে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়েছিল সরকারের এজেন্টরা।”

তিনি বলেন, “গুমের ঘটনার পর তার স্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন এবং ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার আশ্বাস ছিল লোক দেখানো। কারণ ওই সময় বিএনপির পাঁচ দিন হরতাল ছিল। আর বিএনপির সে হরতাল ও আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই মিথ্যা আশ্বাস। গুম হওয়ার পরে থানায় জিডি করা হয়, কোর্টে মামলা করা হয়। এরপরও তাকে ফিরিয়ে দেননি শেখ হাসিনা। ইলিয়াস আলীর সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালানোর হাস্যকর নাটক করতে দেখা যায়। উচ্চ আদালতে করা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনার রিট আবেদনের শুনানিও আটকে দেয় সরকার। অর্থাৎ অদৃশ্য হওয়া নাগরিককে ফেরত দেওয়ার উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বাধাগ্রস্ত করে সরকার। সুতরাং ইলিয়াস আলীসহ সব গুম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। বেআইনি গুম-খুনের ফেস্টিভ্যাল পালন করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।”

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, “সমাজে মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টির জন্যই গুমকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে আওয়ামী নাৎসিবাদী শাসকগোষ্ঠী। মূল লক্ষ্য বিরোধী কণ্ঠকে নির্মূল করা, দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাসিবাদী শাসনকে নিষ্কণ্টক করা। এই সরকারের গোটা আমলটাই অপহরণ-গুম-খুন-ক্রসফায়ার এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো আর্তনাদ, হাহাকার তাদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দেশ, গুম-খুনের দেশ হিসেবে পরিচয়দান করেছেন। মহাদুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরিলুট, জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে ক্ষমতাঘনিষ্ঠ লোকজনদের আঙুল ফুলে কলাগাছ বানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত দেড় দশক ধরে দেশের সম্পদের বিরাট অংশ তারা দুবাই, কুয়ালালামপুর, ইউরোপে পাচার করেছে। এসব অনাচার জনচক্ষু থেকে সরিয়ে দিতে গুমের মতো নির্দয় অমানবিক পন্থা অবলম্বন করেছে সরকার।”

‘ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা কাকতালীয় বিষয় বা তাকে গুম করা শুধু সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল বলে আমরা মনে করি না’-এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের বুঝতে হবে কী কারণে ইলিয়াস আলী গুম হলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার অবস্থানের কারণে ইলিয়াস আলী আজ অদৃশ্য। যারা অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাদেরই অত্যন্ত সচেতনভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, আয়নাঘরে আটক করে রাখা হচ্ছে। ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার প্রমাণ অভিনব গুমের শিকার হয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তাকে দুই মাস গুম করে রাখার পর পাচার করা হয়েছে ভারতে। সেখানে তারা তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে দেয়।”

তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৬৫০ জনের বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ১৫ বছরে ৬ শতাধিক মানুষ গুম হয়েছেন। এর মধ্যে একটা অংশ যাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘ তাদের বিভিন্ন সেশনে অনবরত বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও শেখ হাসিনার গুম সরকার এটা নিয়ে তাচ্ছিল্য করে আসছে। এ রকম অসংখ্য পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে রয়েছে।”

রিজভী বলেন, “গুম-খুন-ক্রসফায়ার বাহিনী র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে গুমের মাত্রা কিছুটা কমলেও এখনো গুম হচ্ছে। তবে প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে। সেটা হলো আগে যারা গুম হতো তারা আর ফেরত আসতো না। তবে এখন যারা গুম হচ্ছেন তারা ৫ দিন ৭ দিন এমনকি এক মাস পরেও কেউ কেউ ফেরত আসছে। অথবা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। গুম বাহিনী এখন স্বল্প সময়ের জন্য গুম করছেন। এই স্বল্প সময়ের গুম হওয়াটাও খুবই ভয়ংকর। গুম হচ্ছে একদলীয় ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের নমুনা এবং চরমতম মানবতাবিরোধী অপরাধ। বাংলাদেশে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিরোধী দল ও মত শূন্য একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই গুমকে পথের কাঁটা দূর করার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একের পর এক মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছে। এই নৃশংস গুমের শিকার কেবল সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীই নন, সাইফুল ইসলাম হিরু, সাবেক কাউন্সিলর চৌধুরী আলম, জাহিদুল করিম তানভীর, মো. মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আল আমিন, সাজেদুল ইসলাম সুমন, মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, জাকির হোসেন, মুন্না, মীর আহমদ বিন কাশেম, আবদুল্লাহিল আযমী, ইফতেখার আহমেদ দিনার, সোহেল রানা, মাহফুজুর রহমান সোহেল, জুনায়েদ আহমেদ, আনসার আলী, আল মোকাদ্দাস হোসেন, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, কে এম শামীম আখতার, হুমায়ুন কবির পারভেজসহ অসংখ্য বিরোধী নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। এসব ঘটনা দেশবাসীকে অজানা আতঙ্কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।”

সরকার কোনোভাবেই ইলিয়াস আলীর গুমের দায় এড়াতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “একজন রাজনীতিবিদকে গুম করার মাধ্যমে তার আদর্শকে শেষ করা যায় না। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করা উচিত।”

রিজভী বলেন, “প্রত্যেকটি গুমের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার দায়ী। বিভিন্ন সময় তাদের মুখ থেকেই এ কথা বেরিয়ে আসছে। তাদের কেউ কেউ স্বীকারও করেছেন। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা মানবতার সবচেয়ে ভয়াবহতম অপরাধ। আমি বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীসহ সরকারের গুমের শিকার নেতাকর্মীসহ সবাইকে অক্ষত অবস্থায় যার যার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিন। অন্যথায় একদিন প্রতিটি গুম-খুনের দায়ে বিচারের জন্য তৈরি হোন।”

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, “বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছে ভোট ডাকাত মাফিয়া সরকার। কথা বলতে ভয় পাচ্ছে অনেকেই। গুম, খুন, অপহরণ আতঙ্কে দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি নাগরিক। স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনার অনেক গুণ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, বাচালতা, টাকা পাচার, গুম, অপহরণ আর মানুষ খুন। এই গুণের কারণেই বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বছরের পর বছর ধরে বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন। তার র‌্যাব-পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই কন্ট্রাক্ট কিলিং চালিয়েছে।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বিএনপির কাছে তালিকা চেয়ে তারস্বরে চিৎকার করছেন। ওবায়দুল কাদের সাহেব কিসের তালিকা চাইছেন- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “এর আগেও তো তালিকা দেওয়া হয়েছিল। আর তালিকা তো আপনাদের কাছেই রয়েছে। আইন-আদালত-থানা-পুলিশ তো আপনাদের কবজায়। ওবায়দুল কাদের সাহেবের স্নায়ু শিথিল, মস্তিষ্ক অলস ও হৃদয় দুর্বল হওয়ার কারণে বেশি বেশি অবান্তর কথা বলেন। শেখ হাসিনার বিনাভোটের সরকার অসংখ্য মানুষকে গুম, খুন, অপহরণ করেছে। এদের মধ্যে জাতিসংঘ গুমের একটি তালিকা দিয়েছিল। আজ পর্যন্ত বিনাভোটের সরকার এর কোনো জবাব দিতে পারেনি।”

বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভুইয়া জুয়েল আদালতে জামিন আবেদন করলে তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তার মিথ্যা মামলা ও সাজা প্রত্যাহারসহ অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির জোর আহ্বান জানান রিজভী।