লাইফ স্টাইল | তারিখঃ জুলাই ৩০, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 12865 বার
বিদায় ইসলামি আরবি বছর ১৪৪৩। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৪। করোনার বৈশ্বিক অভিঘাতের এই দুঃসময়ে বছর ঘুরে ফিরে এলো একটি নতুন বছর। করোনার বিষাদময় কালো ছায়ায় বিশ্ববাসীর আজ নাকাল ও নাভিশ্বাস অবস্থা। এই করোনার ভয়াল থাবা থেকে নিষ্কৃতি ও পরিত্রাণ মিলবে এই আশা ও প্রত্যাশায় বিশ্ব মুসলিম হিজরি নববর্ষ বরণে আজ উদগ্রীব। নতুন বছরে বিগত দিনের গ্লানি, অপ্রাপ্তি, হতাশা, বঞ্চনা ও ব্যর্থতা ঝেড়ে মুছে নতুন স্বপ্ন ও অঙ্গীকারে যেন আমরা ঘুরে দাঁড়াই। যদিও ইসলামে নতুন বছর পালনের কোনো অস্তিত্ব নেই, কারণ আল্লাহর দেওয়া প্রতিটি দিনই সুন্দর এবং মঙ্গলময়। আসলে বর্ষপঞ্জি হচ্ছে জীবনের একটা অপরিহার্য প্রসঙ্গের নাম। দিন, মাস আর সালের হিসাব ছাড়া আধুনিক পৃথিবীতে কোনো কাজই চলে না। আমাদের বাংলাদেশে তিনটি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক কাজকর্ম, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি একটা অপরিহার্য মাধ্যম। হিন্দু সম্প্রসায়ের পূজা-পার্বণ, বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ আর কৃষিজীবীদের আবাদি মৌসুমের হিসাব ছাড়া বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব কম নয়। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুসলমানদের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, শবেবরাত, শবেকদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহাসহ ধর্মীয় বিষয়াবলির জন্য হিজরি সালের হিসাব অপরিহার্য। কিন্তু জীবনের প্রাসঙ্গিকতায় ইংরেজি ও বাংলা সালের বিদায় ও বরণে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, হিজরি সালের বেলায় তা মোটেও লক্ষ্য করা যায় না। অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে, তন্মধ্যে হিজরি সাল অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সালের গুরুত্ব অপরিসীম।
হিজরি সাল গণনার ইতিহাস : হিজরি সাল গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রসুল (সা.) এবং তার সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সালের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সালের সূচনা। খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সাল, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশসংবলিত যেসব চিঠি আমাদের কাছে পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোনো চিঠি কোন দিনের, তা নিরূপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রত বোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে।
হজরত আবু মুসা আশআরির চিঠি পেয়ে হজরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহ্বান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামি তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.)সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে ওই সভায় ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামি সাল প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে, তা নিয়ে পরপস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করেন রসুল (সা.)-এর জন্মের মাস রবিউল আওয়াল থেকে বর্ষ শুরু করার। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রসুলের ওফাতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। অন্যান্যের মতে হুজুর (সা.)-এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ করা হোক। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত উমর (রা.) বললেন, হুজুর (সা.)-এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সালের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রসুলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য। এ সম্পর্কে রসুলের বাণী, ‘তোমরা ইহুদি-খ্রিস্টানদের বিরোধিতা করো’- (বোখারি ও আবু দাউদ শরিফ)।
অপরদিকে হুজুর (সা.)-এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে হুজুর (সা.)-এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলামবিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হজরত ওমর (রা.)-এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) এক বাক্যে সহমত পোষণ করে বললেন, এরই পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ। মোট কথা, আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হিজরি সালের গণনা সূচনা করেন। এটাই ছিল হিজরি সালের প্রেক্ষাপট। মুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসাবের মাস হলো ১২টি। হিজরি সালের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যমন্ডিত ও বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাস বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কোরআনে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম’ (সুরা তওবা : ৩৬)। আর এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মহররমের ১০ তারিখে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। এ ছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও এই দিনে আরো অনেক ঘটনা ঘটবে। মহররমের ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নফল রোজা। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রসুল (সা.) কে এই দিন (আশুরার) এবং এই মাসে রমজানের রোজার চেয়ে অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি’ (মিশকাত শরিফ)। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন’ (তিরমিজি)।
চন্দ্রবর্ষ অনুসরণে ইসলামি শরিয়তের বিধান : হিজরি সাল মুসলমানদের সাল। মুসলমানদের উচিত এর অনুসরণ করা। এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা কাম্য নয়। ইসলামি ফিকাহবিদরা চন্দ্রবর্ষের হিসাব রাখাকে মুসলমানদের জন্য ফরজে কিফায়া বলেছেন। অর্থাৎ কেউ কেউ এর খবরাখবর রাখলে সবার দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু সবাই যদি এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায়, তাহলে প্রত্যেকে গুনাহগার হবে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই, চন্দ্র মাসের হিসাবের অনুসরণ নবীজি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত। যাদের অনুসরণ আমাদের জন্য পুণ্যময় ও কল্যাণকর আমল। হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, সৌর হিসাব রাখা ও ব্যবহার করা একেবারেই নাজায়েজ নয়। বরং এই এখতিয়ার থাকবে, কোনো ব্যক্তি নামাজ, রোজা, জাকাত, ইদ্দতের ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে সৌর হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু শর্ত হলো, সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের মধ্যে চন্দ্র হিসাবের প্রচলন থাকতে হবে। যাতে রমজান, হজ ইত্যাদি ইবাদতের হিসাব জানা থাকে। এমন যাতে না হয়, শুধু জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য কোনো মাসই তার জানা নেই। আর হিজরি নববর্ষের মুসলমানরা কোনো আনন্দ-উৎসব করবে না, তবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সহকর্মীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা গ্রহণ করবে। হিজরি নববর্ষে মুসলমানদের নবউদ্যমে উদ্দমী হতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে।
পরিশেষে আরবি হিজরি সালের প্রতিটি মাসই বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমরা হিজরি নববর্ষে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার দরবারে মোনাজাত করি হে মহান রাব্বুল আলামিন! সারা বিশ্বের বর্তমান করোনা মহামারি থেকে মুসলমান ও সব মানবজাতিকে সুস্থতা ও সুখে-শান্তিতে-সমৃদ্ধিতে তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবন মঙ্গল এবং বরকতময় করে তোলো। বিশ্বময় রক্তক্ষয়ী অবস্থা থেকে আমাদের রক্ষা করো।
ইনশাআল্লাহ, ১৪৪৪ হিজরি আমাদের সবার জীবনে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে। আমিন।
সুত্র : দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য