অন্যান্য | তারিখঃ অক্টোবর ১৬, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 2755 বার
সানজিদা আক্তার সান্তনা : প্রেসিডেন্ট নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সুট-বুট পড়া তেজী এক ব্যক্তিত্ব। যার চারপাশে থাকবে অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত গাড়ির বহর এবং তার জীবন যাপন হবে রাজার মতো।
তবে আজ আপনাদের এমন এক প্রেসিডেন্টের গল্প শোনাবো যিনি দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া সত্ত্বেও হতদরিদ্রের বেশে জীবনযাপন করতেন।
বিশ্বের সবচেয়ে গরীব এই প্রেসিডেন্টের নাম হলো হোসে মুহিকা। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট।
উরুগুয়ের সাবেক এই রাষ্ট্র প্রধানের জন্ম হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২০শে মে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে। তার বাবা দিমিত্রিও মুহিকা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। অন্যদিকে মা লুসি করডানা ছিলেন ইতালিয়ান মাইগ্র্যান্ট।
বয়স পাঁচের অঙ্ক ছোঁয়ার আগেই বাবাকে হারিয়ে ফেলেন মুহিকা। বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্রতার মারপ্যাঁচে পড়ে খুব অল্প বয়সেই জীবন সংগ্রামে নেমে পড়েন উরুগুয়ের এই অবিসংবাদিত নেতা।
সংসারের খরচ জোগাতে স্থানীয় এক বেকারিতে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়, পরিবারের পেট চালাতে কখনো তিনি হোটেল বয় হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো আবার রাস্তায়-রাস্তায় ফুল বিক্রি করেছেন।
আর এই সীমাহীন দারিদ্র্যতাই তাকে বাম রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ষাট ও সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিউবান বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে উরুগুয়ের বামপন্থী গেরিলা দলের হয়ে নেতৃত্ব দেন মুহিকা।
গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে উরুগুয়ের কারাগারে প্রায় ১৫ বছর জেল খেটেছেন জনমানুষের এই নেতা। তবে উরুগুয়েতে গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে আসার পর পুরোদমে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন হোসে মুহিকা।
রাজনীতিতে হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে যান রাষ্ট্রপ্রধানের কাতারে। ২০০৯ সালে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করা হয় তাকে।
তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই মুহিকার কিছু কর্মকান্ড উরুগুয়ের জনগনের পাশাপাশি পুরো বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে বেতন তিনি পেতেন, তার ৯০ শতাংশ অর্থই তিনি তার দেশের কল্যাণে দান করে দিতেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে যে বিলাসবহুল বাড়ি দেওয়া হয়েছিল, সেই বাড়িটিও তিনি হাসিমুখে বর্জন করেছিলেন।
দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও হোসে মুহিকা থাকতেন নিজের পুরাতন ভাঙ্গা বাড়িতে। তার বাড়িটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই বাড়িতে কোনো ভিখারি নয় বরং দেশের প্রেসিডেন্ট থাকে।
ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সামান্য একজন সরকারি আমলাও নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে হোসে মুহিকার সেকেলে গাড়িটি যেন আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
মহান এই নেতার একমাত্র দামী সম্পদ হিসেবে এই গাড়িটিকেই দেখানো হয়েছে। ১৯৮৭ সালে কেনা ভক্সওয়াগেন বিটল গাড়িটি বিশ্বে আর কেউ এখনো ব্যবহার করে বলে মনে হয় না। তবে মুহিকা তার হাল আমলের গাড়িটি দিয়েই গোটা জীবন চালিয়ে দিয়েছেন, যা এক কথায় অনবদ্য।
উরুগুয়ের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমানে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানী মন্টেভিডিওর বাইরের ছোট এক গ্রামে বসবাস করছেন। নিঃসন্তান এই দম্পত্তি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করছেন।
উরুগুয়ের একসময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, বর্তমানে ফুল চাষ করে নিজের ও স্ত্রীর আহার যোগাচ্ছেন। তার পুরাতন ভাঙ্গা বাড়িটিই বলে দেয় জীবনে তিনি অর্থ-প্রতাপের পিছনে নয় বরং মানবতার কল্যাণে ছুঁটেছেন।
মজার ছলে কেউ যদি তাকে গরীব প্রেসিডেন্ট ডেকে বসে তখন সাদামাটা মুহিকা হাসিমুখে উত্তর দেন, “গরিব হলো তারা, যাদের সব কিছু খুব বেশি বেশি দরকার। আমি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চাই আর আমি সেভাবেই বেঁচে আছি।”
অধিকাংশ মানুষের কাছেই প্রেসিডেন্ট মানেই যেখানে দাম্ভিক, উচ্চাভিলাষী, অহংকারে ভরা, সেখানে ব্যতিক্রমী এক জননেতার নাম হোসে মুহিকা।