বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের বিরুদ্ধে নন ব্যাংকিং সেবা, বাড়ি ভাড়া ও প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ১১ কোটি সাড়ে ৩৩ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। সুদসহ ফাঁকি দেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকার হাউজগুলোর মধ্যে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা লংকাবাংলা ফাইন্যান্স বছর বছর শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দেয়ায় ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি খালি চোখে ধরা পড়েনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া প্রতিষ্ঠানটি একসময় প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করলেও পরবর্তী সময়ে আইপিও প্রক্রিয়ায় আসতে পারেনি। সে সময়ও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অস্পষ্টতা নিয়ে অভিযোগ ছিল।

ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন যেভাবে

রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর সফুরা টাওয়ারের লেভেল-১১তে কার্যালয় থাকা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উদঘাটনে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে (ভ্যাট গোয়েন্দা) নির্দেশ দেয়া হয়। তারা বিষয়টি নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। তারপর লংকাবাংলার কাছ থেকে ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলপত্র, দাখিলপত্র, বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন চাওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে লংকাবাংলার দেয়া তথ্যেই বেরিয়ে আসে বড় পরিসরে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি।

ভ্যাট গোয়েন্দারা লংকাবাংলার ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠান উত্তর কমিশনারেটে। তারপর ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।

কী আছে ভ্যাট গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে

ভ্যাট গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লংকাবাংলার ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪২ টাকা। অপরিশোধিত ভ্যাট বা মূসকের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ ৯ কোটি ২৬ লাখ ৮২ হাজার ৫৬৪ টাকা। সুদসহ অপরিশোধিত ভ্যাট ২০ কোটি ৬০ লাখ ৪১ হাজার ৬০৬ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ বছরে নন ব্যাংকিং সেবা প্রদান, গ্রহণে মাসিক দাখিলপত্র, ট্রেজারি চালানে পরিশোধিত ভ্যাট, উৎসে ভ্যাট, স্থান-স্থাপনার ভ্যাট যাচাই করে এ ফাঁকির পরিমাণ উদঘাটন করে তদন্ত কমিটি।

অফিস ও স্থাপনা ভাড়ায় ফাঁকি

লংকাবাংলা ফাইন্যান্স অফিস ও স্থাপনা ভাড়ার ক্ষেত্রে সরকারকে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৭ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০১১ সালের একটি স্ট্যাটিউরি রিগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) অনুযায়ী, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ৯ শতাংশ হারে মূসক দেয়ার নির্দেশ দেয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে আরও একটি এসআরওর মাধ্যমে মূসকের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়।

লংকাবাংলার মূসক ফাঁকির বিষয়টি যেহেতু ২০১৩ সালে থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাই দুটি এসআরও এখানে কার্যকর হবে।

প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী খরচ ও ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধিত মূসকের পার্থক্যে ফাঁকি বের হয়ে আসে।

২০১৩ সালে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ৩ কোটি ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৬ টাকার সেবা বিক্রি করেছে। এর মধ্যে ২ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩ টাকার ওপর মূসক প্রযোজ্য। এর বিপরীতে ২৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৬২ টাকা মূসক দিতে হতো, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মূসক দিয়েছে ২৪ লাখ ৭৩ হাজার ৮০৬ টাকার। ওই বছর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৬ টাকা।

এভাবে প্রতি বছরই প্রতিষ্ঠানটি মূসক ফাঁকি দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ফাঁকি দিয়েছে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে। ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ১১ কোটি ২৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬৯ টাকার সেবা বিক্রির বিপরীতে ৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪২ হাজার ৯২৯ টাকার ওপর মূসক প্রযোজ্য ছিল।

সে বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৯ টাকার মূসক দিতে হতো, তবে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ২৯০ টাকা ফাঁকি দিয়ে তারা পরিশোধ করেছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৯ টাকা।

ভ্যাট আইন, ১৯৯১ এর ৫৫ ধারা অনুযায়ী, এই টাকা অনতিবিলম্বে আদায়ের বিধান রয়েছে।

উৎসে ভ্যাট ফাঁকি

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিগ্যাল অ্যান্ড প্রফেশনাল ফি, কোর্ট স্ট্যাম্প, টেলিকমিউনিকেশন, কুরিয়ার, বিজ্ঞাপন, প্রিন্টিং, স্টেশনারি, বোর্ড মিটিং, বার্ষিক অডিট ফি, প্রভিডেন্ড ফান্ড অডিট ফিসহ প্রায় ৪০ ধরনের ব্যয়ের বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে ৮ কোটি ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭২ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। আইন অনুযায়ী লিমিটেড কোম্পানির ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য।

এ ধরনের উৎসে ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সরকার এই ধরনের আয় নিশ্চিত করতে পারে না বলে তা উৎসে থেকে কর্তন করে নেয়। লংকাবাংলা সে সুযোগটিই নিয়েছে।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৩১ লাখ ৪৮ হাজার ৭১৮ টাকা, ২০১৪ সালে ১ কোটি ৬১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭১ টাকা, ২০১৫ সালে ২ কোটি ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬২ টাকা, ২০১৬ সালে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৪ টাকা এবং ২০১৭ সালে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৭১ টাকার উৎসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

নন ব্যাংকিং সেবায় ফাঁকি

ব্রোকারেজ হাউজের আয়ের বিপরীতে মূসক দিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন নন ব্যাংকিং সেবার বিপরীতেও সরকারকে কর দিতে হয়।

২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউজের আয়, ক্রেডিট কার্ডের কমিশন, লিজ ফাইন্যান্স, টার্ম লোন, শর্ট টাম লোন, ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স, অটো লোন, হোম লোন, পারসোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ড, এসএমই ফাইন্যান্স, মেম্বারশিপ ফি অফ ক্রেডিট কার্ডসহ প্রায় ১৭ থেকে ১৮ ধরনের নন ব্যাংকিং সেবার বিপরীতে ২১ কোটি ৩৯ লাখ ১৬ হাজার ১৭৬ টাকা মূসক দেয়ার কথা লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দিয়েছে ১৮ কোটি ৪৬ লাখ ২৫ হাজার ৫১৪ টাকা। কোম্পানিটি বাকি ২ কোটি ৯২ লাখ ৯০ হাজার ৬৬২ টাকা সরকারকে পরিশোধ করেনি।

এ ধরনের অপরাধের জন্য মূসক আইন-১৯৯১-এর ৬ ধারা এবং মূসক বিধিমালা, ১৯৯১-এর ২৩ বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অপরিশোধিত মূসক আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে এনবিআর।

লংকাবাংলার বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ২০১৩ সালের কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউজের আয়, ক্রেডিট কার্ডের কমিশন, লিজ ফাইন্যান্স, টার্ম লোন, শর্ট টাম লোন, ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স, অটো লোন, হোম লোন, পারসোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ড, এসএমই ফাইন্যান্স, মেম্বারশিপ ফি অব ক্রেডিট কার্ডসহ প্রায় ১৭ থেকে ১৮ ধরনের নন ব্যাংকিং সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট এক কোটি ৫২ লাখ ২৮ হাজার ১০৬ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ২০ লাখ ৩৬ হাজার ২৯৯ টাকা পরিশোধ করেনি।

একইভাবে ২০১৪ সালে ১৭ থেকে ১৮টি সেবার বিপরীতে ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৭২১ টাকা, ২০১৫ সালে ৪৪ লাখ ২৫ হাজার ৭৭৫ টাকা, ২০১৬ সালে ৭১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৮ টাকা ও ২০১৭ সালে এক কোটি ৩৫ লাখ ৩২ হাজার ১০৭ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি।

পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৭টি নন ব্যাংকিং সেবার ওপর প্রযোজ্য দুই কোটি ৯২ লাখ ৯০ হাজার ৬৬২ টাকার ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।

নন-স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি

ভ্যাট গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী স্থান-স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ৯ শতাংশ, ২০১৬ সালের আদেশ অনুযায়ী ১৫ শতাংশ।

লংকাৎবাংলা ফাইন্যান্স ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থান-স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৭ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৯৭ হাজার ৮৫৬ টাকা, ২০১৪ সালে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬৮৯ টাকা, ২০১৫ সালে নয় লাখ সাত হাজার ৭০৬ টাকা, ২০১৬ সালে ১০ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৮ টাকা, ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ২৯০ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের নন ব্যাংকিং সেবার আয়ের বিপরীতে মোট ভ্যাট দুই কোটি ৯২ লাখ ৯০ হাজার ৬৬২ টাকা, প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট ৮ কোটি সাত লাখ ৩৩ হাজার ৭২ টাকা ও স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৭ টাকাসহ পাঁচবছরে মোট ১১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪২ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি।

ভ্যাট আইন অনুযায়ী পরিহার করা ভ্যাটের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ ৯ কোটি ২৬ লাখ ৮২ হাজার ৫৬৩ টাকা। সুদসহ পরিহার করা মোট ভ্যাট ২০ কোটি ৬০ লাখ ৪১ হাজার ৬০৬ টাকা।

এ ভ্যাট পরিশোধে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।

নোটিশে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়। লিখিত জবাব ও শুনানিতে অংশগ্রহণ না করলে দাবিনামা চূড়ান্ত হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা শাহরিয়ারের ব্যক্তিগত মোবাইলে সম্প্রতি ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। রোববার কল করেও তার ফোন রিসিভ হয়নি। খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।

প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাজি উদ্দিনের সঙ্গে রোববার যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।