হযরত মাওঃ মোঃ শাহাবুদ্দিন গোলদার : রহমত বরকত ও মাগফেরাতের মাস রমযান। এই মাস তাই সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই চায় কীভাবে এ মাস থেকে বেশি বেশি উপকৃত হওয়া যায়। সবাই আন্তরিকভাবে কামনা করে নিজেকে সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে পবিত্র একটি জীবন শুরু করতে।

হিজরী পঞ্জিকার বারোটি মাসের মধ্যে শুধুমাত্র একটি মাসের নামই পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে আর সে মাসটি হলো রমযান। যা এ মাসটির অসামান্য মর্যাদা পরিচয় বহন করে।

রমযান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো রা-মিম-দোয়াদ । আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম, কঠোর সূর্যতাপ, দহন, জ্বলন, তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া। রমযান মাসে যেহেতু নেক আমলের কারণে বিগত গুনাহ বা পাপগুলো বিমোচিত হয়ে যায় কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেজন্যেই এ মাসের নাম হলো রমযান।

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধানের একটি হলো রোযা। তবে এই বিধানটি কেবল আমাদের জন্যেই নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের উম্মাতদের জন্যেও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থাৎ “হে বিশ্বাসিগণ! রোযা যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর আবশ্যিক ছিল তেমনি তোমাদের ওপরও তা আবশ্যিক করা হল; হয়ত তোমরা সাবধানী (ও আত্মসংযমী) হবে।” (সূরা বাকারাহ-১৮৩)

একই সূরায় তিনি আরও বলেছেন :

شَهْرُ‌ رَ‌مَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْ‌آنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْ‌قَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ‌ فَلْيَصُمْهُ

“রমযান মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য দিশারী এবং এতে পথ নির্দেশ ও সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসে (স্বস্থানে) উপস্থিত থাকবে সে যেন রোযা রাখে”। (সূরা বাকারাহ-১৮৫)

রোযার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন: “রোযা একান্তই আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেবো।”

পরকালে যে তিনি কী পুরস্কার দেবেন তার কিছুটা ইঙ্গিত নবী কারিম (সা.) আমাদের দিয়েছেন। সে থেকে রোযাদারগণ নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবার আনন্দ পাবেন। রাসূলে খোদা বলেছেন, ‘রমযান এমন একটি মাস যে মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্যে রোযা রাখাকে ফরজ করে দিয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রোযা রাখবে, তার জন্যে রোযার সেই দিনটি হবে এমন যেন সবেমাত্র সে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে, অর্থাৎ রোযাদার তার সকল গুণাহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিষ্পাপ শিশুটির মতো হয়ে যাবে।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পবিত্র রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, পবিত্র রমজান মাস দয়া, কল্যাণ ও ক্ষমার মাস ৷ এ মাস মহান আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ মাস ৷ এ মাসের দিনগুলো সবচেয়ে সেরা দিন, এর রাতগুলো শ্রেষ্ঠ রাত এবং এর প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান ৷ রহমত বরকত ও মাগফিরাতের মাস তথা পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর দস্তরখান আমাদের জন্যে উন্মুক্ত ৷ তিনি তোমাদেরকে এ মাসে সম্মানিত করেছেন। এ মাসে তোমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস মহান আল্লাহর গুণগান বা জিকিরের সমতুল্য; এ মাসে তোমাদের ঘুম প্রার্থনার সমতুল্য, এ মাসে তোমাদের সৎকাজ এবং প্রার্থনা বা দোয়াগুলো কবুল করা হবে ৷ তাই মহান আল্লাহর কাছে আন্তরিক ও পবিত্র চিত্তে প্রার্থনা করো যে, তিনি যেন তোমাদেরকে রোজা রাখার এবং কোরআন তেলাওয়াতের তৌফিক দান করেন ৷ গুনাহর জন্যে অনুতপ্ত হও ও তওবা কর এবং নামাজের সময় মোনাজাতের জন্যে হাত উপরে তোলো, কারণ নামাজের সময় দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়, এ সময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান, এ সময় কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি তা দান করেন, কেউ তাঁকে ডাকলে তিনি জবাব দেন, কেউ কাকুতি-মিনতি করলে তার কাকুতি মিনতি তিনি গ্রহণ করেন ৷ কেননা পবিত্র কোরআনে সুরা গাফিরের ৫৯ নম্বর আয়াতে তিনি নিজেই বলেছেন,

ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُ‌ونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِ‌ينَ

তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো, নিশ্চয় যারা আমার আমার ইবাদত হতে বিমুখ, তারা লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে৷”

মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.) রমজানের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আরো বলেছেন, হে মানব সকল ! তোমরা তোমাদের আত্মাকে নিজ কামনা-বাসনার দাসে পরিণত করেছো, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একে মুক্ত করো ৷ তোমাদের পিঠ গোনাহর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে, তাই সেজদাগুলোকে দীর্ঘায়িত করে পিঠকে হালকা করো ৷ জেনে রাখ মহান আল্লাহ নিজ সম্মানের শপথ করে বলেছেন, রমজান মাসে নামাজ আদায়কারী ও সেজদাকারীদেরকে শাস্তি বা আজাব দিবেন না এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবেন ৷ হে আল্লাহর বান্দারা ! তোমাদের যে কেউ কোনো মুমিনকে ইফতারি দেবে, আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে একজন দাসকে মুক্ত করার সওয়াব দান করবেন এবং দয়াময় আল্লাহ তাঁর অতীতের গুনাহও ক্ষমা করে দেবেন ৷”

সাহাবীরা আরজ করলেন, অন্যদেরকে ইফতারি করানোর সামর্থ আমাদের সবার নেই৷” তিনি বললেন, রোজাদারদের ইফতারি দেয়ার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে দূরে রাখ, আর সে ইফতারি যদি একটি খুরমার অর্ধেক বা এমনকি সামান্য পানিও হয়ে থাকে ৷”

তিনি (সা.) আরো বলেছেন,জান্নাতের মধ্যে আটটি দরজা আছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান৷ এ দরজা দিয়ে কেবল রোযাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করতে পারবে৷ সেদিন এই বলে ডাক দেয়া হবে- রোযাদার কোথায় ? তারা যেন এই পথে বেহেশতে প্রবেশ করে। এভাবে সকল রোযাদার ভিতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে৷ রাসূলে খোদা আরো বলেছেন, রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মেশক হতেও পবিত্র ও সুগন্ধিময়। সুতরাং রোযা অবস্থায় কেউ যেন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে।

নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি প্রকৃতই দূর্ভাগা বা হতভাগ্য যে রমজান মাস পেয়েও মহান আল্লাহর ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়। বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন আরো বলেছেন, রমজান মাসে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মাধ্যমে কিয়ামত বা শেষ বিচার দিবসের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা স্মরণ কর । অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রদেরকে সাহায্য কর ও সাদাকা দাও। বয়স্ক ও বৃদ্ধদেরকে সম্মান কর এবং শিশু ও ছোটদেরকে স্নেহ কর৷ আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা কর । তোমাদের জিহবাকে সংযত রাখ, নিষিদ্ধ বা হারাম দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে আবৃত রাখ, যেসব কথা শোনা ঠিক নয় সেসব শোনা থেকে কানকে নিবৃত রাখ ৷ এতিমদেরকে দয়া কর যাতে তোমার সন্তানরা যদি এতিম হয় তাহলে তারাও যেন দয়া পায় ৷

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরো বলেছেন, যারা এই মাসে অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাসে নিজ ব্যবহার ও আচার আচরণকে সুন্দর করবে তারা সেদিন সহজেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। যারা এই মাসে ভৃত্য বা অধীনস্তদের কাজ কমিয়ে দেবে মহান আল্লাহ শেষ বিচার দিবসে তার হিসাব সহজ করে দেবেন ৷ যারা এই মাসে অর্থাৎ রমজান মাসে মানুষকে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে, বা অন্যদের দোষ ঢেকে রাখবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ নিজ ক্রোধ থেকে তাদের রক্ষা করবেন ৷ যারা রমজান মাসে এতীমকে আদর যত্ন বা সম্মান করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে সম্মান করবেন ৷ যারা এই মাসে আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করবে ও তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে রহমতের ধারায় সিক্ত করবেন, আর যারা এই মাসে আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে আল্লাহ শেষ বিচার দিবসে তাদেরকে নিজ রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন ৷”

মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে আরো বলেছেন,যে এই মাসে নফল নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন, যে একটি ফরজ নামাজ আদায় করবে তাকে অন্য মাসের সত্তুরটি ওয়াজিব নামাজ আদায়ের সওয়াব দান করবেন ৷ যে কেউ এ মাসে আমার প্রতি বার বার দরুদ পাঠাবে আল্লাহ তার সৎ আমলের পাল্লা ভারী করে দেবেন ৷ আর যে ব্যক্তি এই মাসে অর্থাৎ রমজান মাসে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করবে সে ব্যক্তি অন্য মাসে সমগ্র কোরআন তেলাওয়াতের সমান পরিমাণ সওয়াব পাবে ৷

হে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ! এই মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যেন এ দরজাগুলো তোমাদের জন্যে বন্ধ হয়ে না যায়। এই মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়েছে, তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো যেন এই দরজাগুলো কখনও তোমাদের জন্যে খুলে দেয়া না হয়৷ শয়তানগুলোকে এ মাসে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো সেগুলো যেন তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে না পারে।

রমজান মাস সম্পর্কে নবী করিম (সা.)এর এই ভাষণের এক পর্যায়ে আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বললেন,হে আল্লাহর রাসূল! এ মাসের শ্রেষ্ঠ আমল কি?

রাসূল (সা.) বললেন,হে আবুল হাসান! এ মাসের শ্রেষ্ঠ কাজ বা আমল হলো নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকা।