জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ আগস্ট ২১, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 2906 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলে নেমে আসা ভারতীয় পানিতে দেশের ৮ জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। বুধবার (২১ আগস্ট) সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে এসব জায়গায়। এমন পরিস্থিতিতে এসব এলাকা পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্কও।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। বন্যায় সেখানে এখন পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে সেখাকার বিপর্যয় মোকাবেলা দপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে ভারত। ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতীর জেলা প্রশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা তার সরকারি এক্স একাউন্টে (সাবেক টুইটার) এ কথা জানিয়েছেন।
ফেনীর নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় ১৯৮৮ সালের পর বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়নি আগে কখনো।
ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, সবার কল্পনার বাইরে। এখন অনেক মানুষ পানিতে আটকা পড়েছে। তাদেরকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড।’
ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘খোয়াই, ধলাই, মুহুরী, হালদা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা তা অব্যাহত থাকতে পারে।’
বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে মাঠে নামিয়েছে জেলা প্রশাসন।
উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ড
গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে ফেনীর মঙ্গলবার থেকে ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
ফেনীর স্থানীয় সাংবাদিক দিলদার হোসেন বলেন, জেলার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাবে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার প্রায় সব এলাকা তলিয়ে গেছে”।
মঙ্গলবার রাত থেকে ওইসব এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠন নৌকায় করে পানি বন্দীদের উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যান।
ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয় বুধবার সকালে। এরপরই সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা পানি বন্দীদের উদ্ধারে স্পিডবোট নিয়ে মাঠে নামে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীন আক্তার বলেন, ‘ফেনীর যে সব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তার অনেকগুলো সীমান্ত এলাকা। পরিস্থিতি এতটাই দ্রুতই খারাপ হয়েছে গেছে আমাদের সামাল দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা দুর্গত এলাকায় পানি-বন্দীদের উদ্ধারে কাজ করছি।’
ফেনীর বন্যা দুর্গত তিন উপজেলার বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে চালু করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
নেই বিদ্যুৎ-নেটওয়ার্ক, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ
আগস্টের শুরুতেই মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙনের দেখা দিলেও তখন দেখা দেয়নি। ভারি বৃষ্টিতে গত সোমবার দুপুর থেকে পানি বাড়তে শুরু করে মহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীতে। বিভিন্ন স্থানে বাঁধের ভাঙা জায়গা স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। মঙ্গলবার সকালে থেকে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়। একে একে তলিয়ে যেতে থাকে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার এলাকা।
স্থানীয় সাংবাদিক দিলদার হোসেন নোমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ওই তিনটি উপজেলার অন্তত ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে ডুবে গেছে। এমন কোনো বাড়িঘর নেই যেখানে বন্যার পানিতে তলায়নি। মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু পাখিও এখন পানিবন্দি।’
ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া এলাকার প্রায় বেশিরভাগ রাস্তাই এখন পানির নিচে। এসব এলাকার মাছের খামার, ফসলি জমি সবই তলিয়ে গেছে।
ফেনী থেকে আশিক নোমান নামের একজন বলছিলেন, ‘অন্যান্য সময় এই এলাকায় বন্যা হলেও পানিতে এতটা স্রোত কখনো দেখা যায় নি। এবার পানির তীব্র স্রোতের কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।’
সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করায় অনেকে চৌকি উঁচু করে কোনোরকম বসবাস করছিলে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত। রাতে হঠাৎ আরো পানি বাড়তে শুরু করে। বুধবার সকাল থেকে বাড়িঘর ছেড়ে দিতে হয়েছে অনেককে।
তলিয়ে যাওয়ায় ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। দুর্গতদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরাও কাজ করছেন।
স্থানীয় সাংবাদিক সুমন ভৌমিক বলেন, ‘গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের কারণে আগে থেকেই পানি জমেছিল বিভিন্ন জায়গায়। সেই সাথে নতুন করে বন্যার পানি আসতে শুরু করে মঙ্গলবার থেকে।’
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির শতাধিক গ্রাম তলিয়েছে পানির নিচে। এই উপজেলার মাছের খামার, ঘরবাড়ি ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। এই এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গত তিন দশকেও এই এলাকায় এমন বন্যা পরিস্থিতি দেখেন নি তারা। এলাকার পানিবন্দি অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে টানা চারদিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধ-লাখ পরিবার। ঢলের স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ সড়ক।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘ওইসব এলাকা ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।’
ত্রিপুরায়ও বন্যা, বাঁধ খুলে দিয়েছে ভারত
তীব্র বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ত্রিপুরায় অন্তত সাত জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। আরও দুজন নিখোঁজ বলে জানাচ্ছে স্থানীয় সূত্রগুলো। বৃষ্টিপাতের ফলে হাওড়া, খোয়াই, মুহুরী ও ঢলাইসহ রাজ্যের প্রায় সব নদীই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
এমন পরিস্থিতিতেই ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দেওয়া হয়েছে রাজ্যটির প্রশাসক। এই বাঁধ খুলে দেয়ায় ভারতের পানি ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে, যা সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে খুলে দিয়েছিল ভারত।
গোমতী জেলার জেলাশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা তার সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যাণ্ডেলে জানিয়েছেন যে, গোমতী নদীতে জলস্তর বেড়ে যাওয়ার ফলে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তরও বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে জল ছেড়ে দিতে হয়েছে।’ এ কারণে নীচু অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী মানুষজনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া বিজ্ঞান দফতর বলেছে, পুরো ত্রিপুরা রাজ্যেই আগামী দু’দিন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
সতর্ক বার্তায় জানানো হয়েছে, যে পশ্চিম ত্রিপুরা ও খোয়াই জেলায় বুধবার ভারী বৃষ্টিপাত হবে। ওই দুই জেলায় লাল সতকর্তা জারি করা হয়েছে। বাকি ছয়টি জেলায় কমলা সতর্কতা জারি হয়েছে। রাজ্য ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, সিভিল ডিফেন্স এবং দমকল বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। গোটা রাজ্যে ১৮৩ টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে, যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর জানিয়েছে। -বিবিসি