গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : একের পর এক ঝামেলা যেন পিছ ছাড়তে চাইছে না ভারতের বৃহত্তম আদানি শিল্পগোষ্ঠীর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রসিকিউটরদের তরফে জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি ও তার ভাগ্নের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

বিবিসি বলছে, আদালতের এই পদক্ষেপ ৬২ বছর বয়সী ধনকুবের আদানির জন্য নতুন এক ধাক্কা, যার ব্যবসার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে আছে বন্দর ব্যবস্থাপনা থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত।

এমনই এক ধাক্কা যেন কেনিয়ার তরফে চুক্তি বাতিল। জালিয়াতির খবর পাওয়ার পর আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের দুটি চুক্তি বাতিল করেছে কেনিয়া। এর মধ্যেই আবার অস্ট্রেলিয়ায় আদানির একটি কয়লা খনিতে মানবাধিকারের অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে যখন আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনার তোড়জোড় চলছে, সে সময় গৌতম আদানি ও গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় বাংলাদেশে তাদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার পথ সংকুচিত হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গৌতম আদানিসহ তার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়া এবং প্রতারণার অভিযোগ এনে গত বুধবার নিউইয়র্কে অভিযোগ করা হয়।
বাংলাদেশ ও আদানি

আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তি একতরফা- এই অভিযোগ এনে হাইকোর্টে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ নভেম্বর চুক্তি তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠন ও দুই মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয় আদেশে।

এ চুক্তির মাধ্যমে আদানি গ্রুপকে তার গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করার অনুমতি দেয় শেখ হাসিনা সরকার। অভিযোগ আছে, এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থহানি হয়, বিদ্যুতের বেশি দাম দেওয়া হচ্ছে আদানিকে।

আদানি ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে চুক্তিটি বিতর্কিত ছিল উল্লেখ করে বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘কারণ এটি টেন্ডার আহ্বান করার মাধ্যমে হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্রে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ নিয়ে আরও চাপ আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ কারণে এটি চুক্তির ভবিষ্যৎকেও সংকটে ফেলতে পারে।’

ড. হোসেন বলেন, ‘আদানি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাংলাদেশ সুবিধাজনক মনে করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযোগ ওঠে ভারতে সরকারি ভর্তুকি পেয়ে সুবিধা নেওয়া আদানি বাংলাদেশে সেই সুবিধা দেয়নি।’

শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে প্রকল্পের দামও নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকায় তারা সে বিতর্ককে পাত্তা দেয়নি।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালের বিদ্যুৎ চুক্তি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। সর্বশেষ হাইকোর্ট এই চুক্তির বিষয়ে উচ্চ-পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় এটি ঢাকাকে পুরো চুক্তিটি পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ দেবে এবং আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে।

আদানি গ্রুপের একটি কোম্পানি আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল) ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঝাড়খণ্ডে ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে।
কেনিয়ার ২৫০ কোটি ডলারের চুক্তি বাতিল

কেনিয়ায় চুক্তি বাতিলের ঘোষণা বৃহস্পতিবার দেশটির পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে জানিয়ে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুতো। তিনি বলেন, ‘আমাদের তদন্ত সংস্থা ও অংশীদার দেশগুলোর দেওয়া নতুন তথ্যের ভিত্তিতে চুক্তিগুলো বাতিল করা হয়েছে। ’ তার এই বক্তব্যে কেনিয়ার সংসদ সদস্যরা উচ্ছ্বসিত।

আদানি গ্রুপ কেনিয়ার প্রধান বিমানবন্দরে ১৮৫ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। বিমানবন্দর প্রকল্পের অধীনে নতুন রানওয়ে এবং জোমো কেনিয়াট্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে উন্নত যাত্রী টার্মিনাল নির্মাণের কথা ছিল চুক্তির আওতায়।

এছাড়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন স্থাপনে কেনিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের একটি চুক্তিও ছিল আদানি গ্রুপের।

তবে এই চুক্তিগুলো নিয়ে কেনিয়ার মানুষ খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। অনেকেই দুর্নীতির আশঙ্কা করছিল।

প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেন। তার সরকার এখন বিমানবন্দর ও জ্বালানি প্রকল্পের জন্য নতুন অংশীদার খুঁজতে কাজ করবে বলে জানান তিনি।
অস্ট্রেলিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন আদানির

এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় আদানির কয়লাখনির কর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের নাগানা ইয়ারবাইন ওয়াঙ্গান অ্যান্ড জাগালিংগু কালচারাল কাস্টোডিয়ানস জানায়, ব্রাভাস মাইনিং অ্যান্ড রিসোর্সেস ইউনিটের বিরুদ্ধে গুরুতর বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ এনে তারা এ সপ্তাহের শুরুতে অভিযোগ করে।

রয়টার্স জানায়, অভিযোগপত্রে বলা হয়, আদানির কর্মীরা আদানির কারমাইকেল কয়লা খনির কাছে আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন।

নাগানা ইয়ারবাইনের সিনিয়র কালচারাল কাস্টোডিয়ান আদ্রিয়ান বুরাগুব্বা এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে আদানির কাছ থেকে বৈষম্য সহ্য করেছি। গত বছর আমাদের আইনজীবীরা আদানির কর্মীদের উদ্বেগজনক আচরণের জন্য নোটিস দিয়েছেন। কিন্তু তারা এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অস্বীকার করেছে। তাই আমরা মনে করি, আইনি আশ্রয়ই একমাত্র সমাধান।”
যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

এর আগে, প্রতারণার এক মামলায় আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত। এই মামলায় আদানি ও তার ভাগ্নে সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২৫ কোটি ডলার ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে তথ্য গোপন করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয় মামলায়।

বিবিসি বলছে, আদালতের এই পদক্ষেপ ৬২ বছর বয়সী ধনকুবের আদানির জন্য নতুন এক ধাক্কা, যার ব্যবসার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে আছে বন্দর ব্যবস্থাপনা থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত।

ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় আদানিকে এখন দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।

গৌতম আদানি ও তার ভাতিজা সাগর আদানিসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা ভারতের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঘুষ দেন। এই প্রকল্প থেকে ২০ বছরে ২০০ কোটি ডলার লাভ করতে পারবে আদানি।

তবে আদানি গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিকিউটরদের আনা অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করে।
এরপর কী?

আদানিকে বিচারের মুখোমুখি করতে চাইলে মার্কিন প্রসিকিউটরদের যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে ভারতের কাছে চাইতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আদানিকে চাওয়ার আবেদন করলে ভারতের আদালত সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন, আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটি ভারতেও অপরাধ কি না, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না বা যুক্তরাষ্ট্রে আদানির অমানবিক আচরণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না।

আদানি এই প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে লড়তে পারেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে তা স্পষ্ট নয়।

কী শাস্তি হতে পারে?

অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদানির কয়েক দশকের জেল হতে পারে, সঙ্গে আর্থিক জরিমানাও। তবে বিষয়টি বিচারকের ওপর নির্ভর করে। আদানিকে অভিযুক্ত করতে হলে ১২ জনের একটি জুরির সর্বসম্মত ভোট লাগবে। এ ছাড়া আদানি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন।