নিজস্ব প্রতিবেদক : শনিবার সদ্যসাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীরাও। এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়

সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান গতকাল শনিবার সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছিলেন। ভার্চুয়ালি এ সভা হওয়ার কথা ছিল। সভা ডাকার খবরে ওইদিনই সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং সদ্যগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, “ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানা অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনোপ্রকার আলোচনা না করে ফুল কোর্ট মিটিং ডেকেছেন। পরাজিত শক্তির কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না।”

এরপর ৯টা ১৪ মিনিটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে একই কথা লিখে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। এর পর ফেসবুকে লাইভে এসে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ‘জুডিশিয়ারি ক্যু’ রুখে দিতে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের আহ্বান জানান।

এসব পোস্ট থেকেই সামনে আসতে থাকে সদ্যপদত্যাগী প্রধান বিচারপতির ‘জুডিশিয়ারি ক্যু’-এর পরিকল্পনার কথা। অবশেষে বিস্তারিত পরিকল্পনাই ফাঁস হয়ে যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে জুডিশিয়াল ক্যু করার কথা ছিল। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ওই সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ছিলেন এ ষড়যন্ত্রের পেছনে।

শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে সহসমন্বয়ক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদের পোস্ট থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা জুডিশিয়াল ক্যুয়ের পরিকল্পনার তথ্য পেয়ে গেলে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে পোস্টে।

উল্লেখ্য, শনিবার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মুখে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এরপর আপিল বিভাগের আরও ৫ বিচারপতি পদত্যাগ করেন।

কী ছিল ক্যু’র পরিকল্পনায়

সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে জুডিশিয়াল ক্যু করার যে ষড়যন্ত্র ছিল তার ফাঁস করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ। সেখানে সহসমন্বয়ক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ ‘ষড়যন্ত্র ফাঁস’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেন। তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের নেপথ্যে কঠিন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে এক্স প্রধান বিচারপতি সিনহা যেভাবে অবৈধ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ষড়যন্ত্র করেছিল ওবায়দুল হাসানসহ কয়েকজন।

যে রিপোর্ট এখনও মিডিয়া প্রকাশ করেনি তা নিম্নরূপ:

সজীব ওয়াজেদ জয় এতদিন আপনাদের সাথে ‘আমি নাই, মা নাই’ বলে বলে হঠাৎ গতকাল (শনিবার) রয়টার্সকে বলেছেন তার মা পদত্যাগ করেননি। এটি একটি পরিকল্পিত ঘোষণা ছিল যা বোঝা গেছে আজ।

সেনাবাহিনীর নিচের দিকের অফিসাররা যদি জনগণের পক্ষে না থাকত, তাহলে আজকে আরেকটা রক্তের বন্যা বয়ে যেত। আজকেও সেনাবাহিনীর ছোট অফিসাররা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে ছাত্র জনতাকে বাঁচিয়েছে।

আজকে একটা ক্যুয়ের প্ল্যান করেছিল জয় এবং আরাফাত। কিন্তু সঠিক সময়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা ছাত্রদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেয়। এই তথ্য জানার পরে জুডিশিয়াল ক্যু রুখে দেয় ছাত্ররা।

জয় আরাফাত আর তাদের গাইডদের গোপন প্ল্যান ছিল এইরকম। ড. মোহাম্মদ ইউনুস যখন রংপুরে আবু সাঈদের বাড়ি পরিদর্শন এবং কবর জিয়ারতের জন্য যাবেন এবং তারপর উনার হেলিকপ্টার যখন আকাশে থাকবে, ঠিক সেই সময়ে হাইকোর্টের অ্যাপিলিয়েড ডিভিশনের বিচারপতিরা ফুলকোর্ট বসিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করবেন। সাথে সাথে এই ক্যুয়ের সাথে জড়িত সেনাবাহিনীর ২৫ কর্মকর্তা, চাকরি থেকে কর্মবিরতিতে থাকা দুর্নীতিবাজ পুলিশের একটি দল রাজধানীতে হট্টগোল শুরু করবে আর শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসবেন এবং সাথে সাথে আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা মাঠে চলে আসবেন।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধান বিচারপতি সরকারের সাথে কোনো আলোচনা না করে হঠাৎ ৫৭ বিচারপতিকে জরুরি মিটিংয়ে ডাকেন। স্ক্রলে জরুরি মিটিং ডাকার সংবাদ দেখে দর্শকরাও কনফিউজড হন। কিন্তু আগে থেকে গোপন খবর পাওয়া ছাত্র-জনতা সকাল ৯টার আগেই চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে হাইকোর্ট ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সমর্থনে প্রধান বিচারপতি পিছু হটতে বাধ্য হন এবং পালিয়ে থাকেন। মিটিং স্থগিত হয়। ছাত্ররা বিচারপতির বাসা ঘেরাও করে রাখে। সেনাবাহিনী শৃংখলা রক্ষার আবরণে সেখানে ছিল। পদত্যাগপত্র সরকারকে দেওয়া হয়েছে নিশ্চিত হয়ে ছাত্ররা হাইকোর্ট এবং বাসভবন ত্যাগ করে।

এই ঘটনার সাথে জড়িত আপিল বিভাগের আরও পাঁচজন বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে শনিবার ‘ষড়যন্ত্র’ ভেস্তে যাওয়ার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ওইদিন রাত ১টা ১৭ মিনিটে দেওয়া পোস্টে জয় লিখেছেন, “আজ প্রতিবাদকারীরা সুপ্রিম কোর্টে আক্রমণের হুমকি দিয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তারা আদালতের পদত্যাগ দাবি করেছে এবং তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগের একটি তালিকা সরবরাহ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং প্রতিবাদকারীদের মনোনীত বিচারকদের নিয়োগ করেছে। একটি দেশের সুপ্রিম কোর্টকে কোন প্রক্রিয়া ছাড়াই, নির্বাচিত সংসদ ছাড়াই কিভাবে পরিবর্তন করা যায়? এটি সংস্কার নয়, এটি গণঅরাজকতা। বাংলাদেশে কোনো আইনশৃঙ্খলা নেই যখন এমনকি সুপ্রিম কোর্টও নিরাপদ নয়।”

সজীব ওয়াজেদ আরও বলেন, “প্রতিবাদকারীরা প্রেসক্লাবে ৪১ জন সাংবাদিকের একটি তালিকাও দিয়েছে এবং তাদের বহিষ্কারের দাবি করেছে। আমার মায়ের সরকারের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের অভিযোগ আনার পর, এটি কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আরও গুরুতর আক্রমণ নয়? তাহলে কি এখন জনতা সাংবাদিকদের বহিষ্কার করার জন্য তালিকা দেবে? আমি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত শুনতে চাই। আপনারা অতীতে এতটা সরব ছিলেন, এখন কেন নীরব?”