আসাদুজ্জামান আসাদ।৷ রুটিরুজির সন্ধানে ওরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসে বাংলাদেশে। ওদের ঘর আছে, বাড়ি আছে, আছে পরিবারও। এসবের পরও তারা পরিবার ও পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন।

ভিন দেশের বন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকিয়ে বেরুতে না পারায় ধর্মীয় উৎসবে পরিবারের সাথে শামিল হতে পারে না অনেকে।এটাকে তারা নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়।

বাংলাদেশের ট্রাক চালকরা সাধারনত রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া সারে কিন্ত ওদের থাকা খাওয়ার ব্যাপারটাও একেবারে ভিন্ন।নিজেদের রান্না নিজেরাই করে থাকে। প্রতিটি ট্রাকে থাকে রান্নার সরঞ্জাম।যখন বিশ্রামের প্রয়োজন তখনই ট্রাক রেখে করে নাওয়া খাওয়ার আয়োজন। তাতে এক বেলা খাওয়ার যোগান করলেও আরেক বেলা কাটাতে হয় না খেয়ে। এ ভাবেই ওদের কেটে যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তবে নিজ দেশ থেকে ভিন দেশে আসার পর ওদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে পরিবার পরিজনের সঙ্গে তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় ওদের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়।

যাদের কথা বলছিলাম তারা ভারতের বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যের বাসিন্দা ট্রাকের চালক ও তাদের সহকারি।

দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর হল বেনাপোল বন্দর। এই বন্দরে প্রায় প্রতিদিনই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের চার’শ থেকে পাঁচ’শ ট্রাক নানা ধরনের পণ্য আসে। এসব ভারতীয় ট্রাক চালকরা প্রতিদিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল, গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে খাদ্য ও প্রসাধনী সামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আসে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লী, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ইউকে, বিহার, নাগালেন্ড, হরিয়াণা, জামশেদপুর, কুচবিহার, তামিলনাড়ু পাঞ্জাব, পশ্চিমবাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে তারা রপ্তানিকৃত পণ্য চালান নিয়ে ঢোকে বেনাপোল বন্দরে।

ভারত থেকে আসা এসব ট্রাক চালকরা বেনাপোল বন্দরে পণ্য নিয়ে আসার পর তাদের নানা কষ্টের কথা জানান।

শুক্রবার বেনাপোল বন্দর ঘুরে ভারতীয় ট্রাক চালকদের সাথে কথা বলেছেন গ্রামের সংবাদ এর এই প্রতিবেদক। শুনেছেন তাদের সুখ দুঃখের কথা।

চালকরা জানান, রপ্তানি পণ্য নিয়ে আমরা বেনাপোলে অন্তত ১০দিন আগে এসেছি।সেই থেকে অপেক্ষা করছি।আজ অবধি বেনাপোল বন্দরে আছি। এখনও পর্যন্ত আমাদের ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস হয়নি। যার ফলে আমরা এখানে আটকা পড়ে আছি। কবে কখন তাদের ট্রাকের এসব পণ্য খালাস হবে তা তারা জানেন না।

রাজস্থানের আলোয়ার থেকে আসা ট্রাক চালক আকরব আলি তার দুর্বিসহ জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন,মা বাবা পরিবার পরিজন রেখে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে কাটে।এতে হঠাৎ করে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমরা পাশে থেকে তাদের সেবা করতে পারি না।পরিবারের কোন আনন্দ উৎসবের মুহূর্তেও আমরা তাদের সঙ্গে শামিল হতে পারি না। এতে করে আমরা যেমন কষ্ট পাই। তেমনি করে আমাদের পরিবারও কষ্ট পায়।

রাজস্থান থেকে কেমিক্যাল বোঝায় লরি নিয়ে তিন দিন আগে বেনাপোল এসেছি। এবার ঈদ বাড়িতে করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বেনাপোলে লরি খালি করতে পারলাম না।বাবা মায়ের পাশাপাশি দুই বছরের ছোট মেয়ে আলপিজার কথা বারবার মনে পড়ছে বলেন আকবর আলি।

ভারতের ইউপি থেকে ট্রাক চালক শাহবাজ আজম খান চার দিন আগে বেনাপোল বন্দরে ঢুকেছে। নিয়ে এসেছে মেশিনারি পণ্য চালান।

ট্রাক চালক শাহবাজ আজম খান বলেন, আমি মহারাষ্ট্র নাগপুর থেকে ছত্রিশগড়, রাজেস্থান, উড়িষ্যা, ঝারখ, পশ্চিম বাংলা হয়ে বেনাপোল বন্দরে এসেছি চার দিন হল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেও আমার ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস করাতে পারলাম না। আমার মতো অনেক ট্রাক চালক পণ্য খালাসের জন্য সিরিয়ালে আছে।তাদের কারো ঈদ পরিবারের সাথে হবে না। এটা নিয়তি তাই মেনে নিতেই হয়।

ভারতের দিল্লীর টেংরা এলাকার শফিকুল ইসলাম পেপাররোল নিয়ে বন্দরে ঢুকেছে পাঁচ দিন হল। ঈদের দিন পরিবারকে কাছে পাবে না। মনটা বেজায় খারাপ। শফিকুল বলেন, বাড়িতে দু’টো জমজ মেয়ে আছে।প্রায়ই তাদের সাথে কথা হয়।ওরা ঈদের আগের দিন বাড়ি যেতে বলেছে কিন্তু ওরা তো বোঝে না আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভিন দেশে আছি।

ভারতের উত্তর প্রদেশের ট্রাকচালক চন্দ্র লাল সিংহ বলেন, দশ দিন ধরে আছি বেনাপোলের ট্রাক টার্মিনালে।এখানে নেই কোন ক্যান্টিনের ব্যবস্থা। নেই থাকার ব্যবস্থা। যে কারনে আমাদের ট্রাকের ভেতরেই রান্না বাড়া করে খেতে হয়। প্রচন্ড গরমে টার্মিনালের ভেতরে নেই ছাওনির ব্যবস্থা। রোদ, বৃষ্টি ও দাবদাহের মাঝেও আমাদের ট্রাকের ভিতরেই দিন কাটাতে হয়। দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও তেমন একটা হয়ে ওঠে না। এ নিয়ে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে দিন কাটাই।

ভারতের উত্তর প্রদেশের কৌশ্বামী থানার বিধানপুর এলাকার ট্রাকচালক শিব নরেশ যাদব বলেন, চেন্নাই থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেনাপোল এসেছি। গুদামে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পণ্য খালাস করতে পারিনি।যে কারণে আমাদের প্রতি মুহূর্ত ট্রাকের ভিতরেই কাটাতে হচ্ছে।আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমরা প্রায় প্রতিদিনই গেটপাশ দেখিয়ে ওপার থেকে নিয়ে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে খাই।

বিহারের জিতেন্দ্র কুমার যাদব(৪০) বাড়ি থেকে এক মাস আগে বেরিয়েছে। জিতেন্দ্র কুমার যাদব বলেন, দু’দিন হল আমি বাংলাদেশের বেনাপোল বন্দরে পণ্য নিয়ে এসেছি।আসার পরদিন খবর পেলাম বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাবার অসুস্থতার কথা শুনেও আমার করার কিছু নেই। কারণ আমার ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস হয়নি। আর খালাস হলেও আমার বিহার পৌঁছাতে সময় লাগবে বেশ ক’দিন। এ কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসছিল। এ সময় তার চোখ ছলছল করছিল।

যাদব বলেন, সংসারে বাবা মায়ের পাশাপাশি স্ত্রী ও তিনটি বাচ্চা আছে। দুই বছরের ছোট বাচ্চা আনিসকা কুমারি কথা সব সময় মনে পড়ে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম জানান, বন্দরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে পণ্য খালাসে বিলম্ব হলেও ট্রাক চালক ও তাদের সহকারির থাকা এবং খাওয়ার জন্য সেখানে ক্যান্টিন আছে। কিন্তু ভারতীয় ট্রাক চালকরা সেগুলো ব্যবহার না করে নিজেদের মতো নিজেরাই রান্নাবান্না করে খায়। তারা ট্রাকের মধ্যে ঘুমায়। এজন্য আমাদের কি করার আছে।