আলহাজ্ব মোঃ রবিউল হোসেন : হোমিও প্যাথিক ঔষধের ডাইলেশন কালে (মুল আরক) যত ধাক্কা দেওয়া হয় ততই ওষুধের শক্তি বৃদ্ধিপায় (২০০, ১০০০, ১০০০০০) ইত্যাদি অনুরূপ দেশ বা বিশ্ব রাজনীতিতেও দেখতে পাচ্ছি কোনো না কোন দেশে রাজনীতিতে যতই ঝাকুনি খেয়েছে ততই তার ঝাকুনির তীব্রতা বেড়েছে বা বেড়েই চলেছে।
যেমন উপমহাদেশের রাজনীতিতে মোঘল আমল, বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল অবশেষে বর্তমান বাংলাদেশ আমলে রাজনীতির একাধিক পালাবদলে যে একাধিক ধাক্কা ধাক্কির শিকার হতে হয়েছে, এতো ধাক্কা ধাক্কিতে বোধ হয় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শক্তি নির্দ্ধারনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে মূল লক্ষ্যও হারিয়ে যেতো বৈকি।
বলাবাহুল্য একাধিক রাজশক্তির পালাবদলে যে সকল রাজৈনতিক বিপ্লব সঙঘটিত হয়েছে ততই ঘটেছে সম্পদ ও প্রানহানী যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকেই। রাজনীতির পালাবদলে রাজনৈতিক হত্যা, অসংখ্য প্রানহানী, জ্ঞানীগুনী ও বুদ্ধিজীবি হত্যা সহ হিংসার দাবানলে পরষ্পর রজিনৈতিক দলের মধ্যকার মিমাংসিত ও অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ, ফ্যাসাদ, ফাঁসি, গুম, খুন, হত্যার কারণে রাজণৈতিক নেতৃত্বের শূণ্যতায় রাজনীতির মূল্য ইস্যু অর্থাৎ গনতন্ত্র আজ সারা বিশ্বে যতোনা ততধিক বাংলা দেশে আবমূল্যায়িত। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধাক্কা-ধাক্কি বেশি খাওয়ায় রাজনীতির মূল ইস্যু গনতন্ত্র আজ খেই হারা ।
বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মানুক আর নাই মানুক যে কথাগুলো তৃনমূলে আলোচিত, সে কথাটি হলো- আগে নেতা বা নেতৃত্ব না গনতন্ত্র? অভিভাবক দক্ষ ও প্রজ্ঞাশীল না হলে যেমন ব্যক্তি সংসার টেকে না তেমনি দক্ষ, প্রজ্ঞাশীল রাজনৈতিক নেতা না হলে দেশ বা সেই দলের রাজনীতিও টেকে না। দেশে গনতন্ত্রের পরাজয় ঘটেছে সুদক্ষ, প্রজ্ঞাশীল রাজনৈতিক নেতার অভাবে । বিষয়টির ব্যাকগ্রাউন্ডে বিদেশ বা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত থাকলেও স্বদেশিদের লোভ, লালশা ও স্বদেশপ্রেমের অভাবে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশটি পূর্ণ স্বাধীন হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর স্বপরিবারের প্রায় সকল সদস্যদেরকে হত্যার মাধ্যমে এ দেশে গনতন্ত্র হত্যার রাজনৈতিক ইস্যু বা বীজরোপিত হয়েছিল কিনা সেটিও জাতিকে এখন ভেবে দেখতে হবে। কথায় আছে গাছের গোড়া কেটে গাছের আগায় পানি ঢাললে যেমন গাছ বাচে না তেমনি গনতন্ত্রের মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশে বা দেশের মানুষ এখন গনতন্ত্র গনতন্ত্র বলে চিৎকার করলেই কি গনতন্ত্র উদ্ধার হবে? কারণ এক ভুলে তো শত ভুলের জন্ম দিতে পারে ।
আমার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র মতামত এবং তৃণমূলের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এমনি বেশ কিছু বিজ্ঞ মানুষের ধারণা বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকারিরাই বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনাকেই আজীবন এদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের আজীবন সভানেত্রী বানিয়ে রেখে গেছেন। বেড়েছে তাঁর বিশ্বপ্যাপী পরিচিতি ও স্বীকৃতি। বিশ্বের অন্যতম গনতন্ত্র আন্দোলনের নেতা যার একটি ভাষনে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, সেই জননেতার রক্তধারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধমনিতে প্রবাহিত তাই তিনি যেমন সাহসী তেমনি রাজনীতিতেও বর্তমানে ধৈয্যর্শীল প্রজ্ঞাশীলও বটে।
বহু নেতা দলছুট হয়ে নতুন নামে দল গঠনের চেষ্টা নিলেও তাদের দলগুলো নাম সর্র্বস্বমাত্র অথচ তাদের মুখে আজ বড় বড় কথা, গণতন্ত্র উদ্ধারের কথা। কী বলা যায় ?
উল্লেখ্য দেশের একাধিক মানুষ ভোট দিতে না পারলেও এবার দেশব্যাপী (২০২১/২২) ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি নিবার্চনে মানুষ অনেকটা প্রাণ খুলে ভোট দিতে পেরে খুশিতে বাকবাক। এবারকার ইউপি নিবার্চন গণতন্ত্র পুনরুজীতি হলেও বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি সরাসরি নিবার্চনে অংল গ্রহণ না করায় আওয়ামীলীগের স্বদলীয় প্রার্থীদের মধ্যে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রাথীদের মধ্যকার দ্বন্দ ও খুন, যখম, মারামারির মধ্য দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নিবার্চন শেষ হয়েছে সবে মাত্র । ১৬ জানুয়ারী-২০২২ নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নিবার্চনে নিজেদের মেয়াদ কালে সবোর্ত্তম নিবার্চন হয়েছে বলে অভিহিত করেছেন জোষ্ঠ নিবার্চন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। আমরা দেশের একাধিক গণমাধ্যমেও এমন খবর জানতে পেরেছি। খবরে বলা হয়েছে নিবার্চনটি ছিল উৎসব মুখর। ছিলনা সহিংসতা ও অনিমের কোন অভিযোগ। ১৭ই জুনয়ারী বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বলার অবকাশ রাখেনা নিরপেক্ষ দৃষ্টি শক্তি ও অভিজ্ঞতার নিরীক্ষে বিচার বিশ্লেষন করলে দেখা যায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন নিবার্চন এক বিশাল অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে । এ নিবার্চনে আওয়ামীলীগ দলী প্রার্থী ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকার । নিবার্চন কালীন প্রচার প্রচারনায় উভয়ের বক্তব্যই ছিল পরিশলিত, পরিমার্জিত ও গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসৃত । বসন্তের স্নিগ্ধ সমিরণের মতো একটা অদ্ভুদ আমেজ মাখা কী সুন্দর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুই দলের দুই প্রার্থীই সৃজনশীল পরিবেশে দায়িত্বশীল ভাবে নিবার্চনটি মোকাবিলা করেছিলেন। এ যেন পাশ্চাত্য দেশের সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের মতোই প্রবাহমান ছিল। নিবার্চনের ফলাফল ঘোষনার প্রায় শেষ মুহুর্তে পর্যন্ত দুই প্রার্থীর যে বক্তব্য বিবৃতি আমরা শুনছিলাম তাতে মনে হচ্ছিল এ নিবার্চনটি আমাদের স্বস্তির সৈকতে নিয়ে দাঁড় করাবে। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ, নিবার্চন উত্তরকালে অ্যাডভকেট তৈমুর আলম সাহেব তার সহনশীলতার শেষ রক্ষায় কেন জানি একটুখানি বিবর্ন হয়ে গেলেন ।
সুষ্ঠ নিবার্চন করতে হলে বা নিবার্চন পেতে হলে দেশের একজন নারীর তৃতীয় বারের মতো মেয়র হওয়াটা যদিও সহজ নয় তথাপিও সম্ভব হওয়ার মূলে কিন্তু আইভি নারায়নগঞ্জে তার একটা আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি করতে স্বক্ষম হয়েছেন। জনগনের সঙ্গে সম্পর্কটা তিনি আলগা হতে দেননি। নারায়নগঞ্জবাসী মনে করেন তিনি লড়াকু, সাহসী, সৎ । নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনে তিনি দৃশ্যমান কিছু উন্নতি করেছেন। জনগন তাকে বিশ্বাস করে। এ নিবার্চনে আওয়ামীলীগের সবচেয়ে লাভ হয়েছে একটি বিশেষ জায়গায় সেটি হলো আগামী নিবার্চনে আওয়ামীলীগকে জিততে হলে নারায়নগঞ্জ নিবার্চনের মাধ্যমে জয়ের ফরমুলা আওয়ামীলিগ পেয়ে যেতে পারেন। এই ফরমুলার স্তম্ভ হলো চারটি। ১) শেখ হাসিনার ইমেজ ২) উন্নয়ন ৩) ঐক্যবদ্ধ আওয়ামীলীগ ৪) আইভির মত যোগ্য প্রার্থী= আগামী নিবার্চনে আওয়ামীলীগের জয়লাভ । বিষয়টি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও শিক্ষা নিতে পারেন জনগণের প্রকৃত নেতা হতে হলে কেমন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির অভিমত হলো আগামী জাতীয় সংসদ নিবার্চন নিরপেক্ষ করতে হলে সবোর্পরি দেশে গণতন্ত্র উদ্ধারে প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ নিবার্চন করা।
গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য হলো- গণতন্ত্র বর্তমানে কর্ণফুলি টানেলের নিচে আটকা পড়ে গেছে । তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তাই বলেছেন “ গণতন্ত্র উদ্ধারে সুষ্ঠ নিবার্চনের জন্য আপনি (প্রধানমন্ত্রী) পদত্যাগ করে জাতীয় সরকার গঠন করুন” ।১৬ জানুয়ারী, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।
এপ্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, নিরপেক্ষ নিবার্চন নয়, বরং সরকার উৎখাতই বিএনপি-জামাতের আসল উদ্দেশ্য । গত ১৫ জানুয়ারী দুপুরে জাসদের দলীয় কাযার্লয়ে কেন্দ্রীয় কাযর্করী কমিটির সভায় তিনি এ কথা বলেন । ইনু বলেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনীতির মূল বিরোধ নিরপেক্ষ নিবার্চন নাকি ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তনের ধারার সূত্রপাত হয় তা পাল্টে দেওয়া ? নিরপেক্ষ নিবার্চন, নিরপেক্ষ নিবার্চন কমিশন গঠন কি আসল বিষয় নাকি নির্দলীয় সরকারের নামে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা আসল বিষয় ? বিএনপি-জামাত ও তাদের রাজনৈতিক সঙ্গীদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা নিবার্চনের আগেই ক্ষমতার প্রশ্নে ফয়সালা করতে চান।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নারায়নগঞ্জ সিটি নিবার্চনের ভোট ভালো হয়েছে। তবে তার সন্দেহ ইভিএম নিয়ে। কারণ ইভিএম ক্রয়কালে প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্বাক্ষর ছিলনা কারিগরি কমিটিতে। ১৮ জানুয়ারি ২০২২, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সেযাই হোক কথায় আছে “তর্কে তর্ক বাড়ে, ভোজনে বাড়ে পেট” অর্থাৎ তর্কের মিমাংসা নেই । প্রসঙ্গক্রমে সুসাহিত্যক মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা- “রাষ্ট্রনীতি ও স্বাধীনতা” প্রবন্ধে লেখক সত্যই লিখেছেন, যে নেতা বা রাষ্ট্র প্রধানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞানেই, স্বদেশ প্রেম, দক্ষতা ও দূরদশির্তার অভাব, এমন অপাদার্থ সরকারের যত সত্তর পতন হয় রাষ্ট্রের জন্য ততই মঙ্গল । অন্যথায় অযোগ্য অপদার্থ সরকারের কারণে রাষ্ট্রে স্বাধীনতা একবার বিপন্ন হলে তা উদ্ধার করা বড়ই কঠিন হয়ে পড়বে।
পাদটিকা- রাষ্টবিজ্ঞানিরা গণতন্ত্রকে সবার্ধিক শ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা বলে অবহিত করলেও তাদেঁরই মতে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ্যত্ব প্রমান করতে হলে, দক্ষ, ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাশীল সুযোগ্য শাসক বা নেতার যেমন প্রয়োজন তেমনি দেশের নাগরিকদেরও অবশ্যই সুনাগরিক হতে হবে; অন্যথায় যোগ্য ডিকটেটর শাসক এবং একনায়কতন্ত্র শাসন ব্যবস্থাই উত্তম শাসন ব্যবস্থা বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেছেন।
আলহাজ্ব মোঃ রবিউল হোসেন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট