জাতীয় সংবাদ, শিক্ষাঙ্গন | তারিখঃ মে ৬, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 6501 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি ভর্তি হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেলেও সমস্যা নেই। শুধু টাকা দিলেই মিলত দেশের যে কোনো শিক্ষা বোর্ড বা নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। এই জাল সনদগুলো যুক্ত হয়ে যেতো ওইসব বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও। যে কোনো ধরনের যাচাইয়েও আসল বলে টিকে যেত সনদ।
এমন একটি চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিচালকও রয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির নামেই ৪ কোটি টাকার সনদ বিক্রি করা হয়েছে বলে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন চক্রের সদস্যরা। এছাড়া দেশের কয়েকটি শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্বদ্যিালয়ে জাল সনদ চক্রের নেটওয়ার্ক থাকার তথ্যও মিলেছে।
জাল সার্টিফিকেট বিক্রির টাকা দিয়ে চক্রের সদস্যরা রাজধানীতে বিলাসি জীবনযাপন করে আসছিলেন। এসব টাকা দিয়ে তারা ডেভেলপার কোম্পানি বানিয়েছেন। কিনেছেন অভিজাত ফ্ল্যাট।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চক্রে শিক্ষা বোর্ড ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার বিষয়টিও। তারাই মূলত অনলাইন সার্ভারে জাল সনদগুলো অন্তর্ভুক্ত করে আসছিলেন। ৬-৭ বছর ধরে এসব কর্মকান্ড চালানো চক্রটি এ পর্যন্ত ৪ কোটি টাকার সনদ বিক্রি করেছে বলে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। ৫০-১০০ টাকা খরচ করে বানানো একেকটি সার্টিফিকেট এক লাখ টাকা থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করতেন তারা। এ রকম ১ হাজার জাল সনদ বিক্রির কথা গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে চক্রটি। ওইসব সনদ ব্যবহার করে এক হাজার জন বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তবে কে কোথায় চাকরিরত, সে তথ্য এখনও গোয়েন্দাদের হাতে আসেনি বলে জানা গেছে।
গ্রেপ্তরকৃতরা হচ্ছেন- জিয়াউর রহমান, নুরুন্নাহার মিতু, ইয়াসিন আলী ও বুলবুল আহমেদ বিপু। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত দুদিন টানা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর রামপুরা ও লালবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বেশকিছু জাল সার্টিফিকেট ও মার্কশিট জব্দ করা হয়েছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্বদ্যিালয়ের যেসব কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ডের বেশকিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। যারা জাল সনদের অনলাইন ভেরিফিকেশন (যাচাই) ও বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার চারজন একটি চক্রের সদস্য। চক্রটি ৬-৭ বছর ধরে এই জাল সনদ তৈরি ও বিক্রিতে জড়িত। ইতিমধ্যে তারা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে প্রায় চার কোটি টাকার সনদ বিক্রি করেছেন।
ডিসি মশিউর রহমান বলেন, অনেকদিন ধরেই এই অসাধু চক্র টাকার বিনিময়ে চলমান ও বন্ধ হয়ে যাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সার্টিফিকেট ও মার্কশিট, বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট ও মার্কশিট বিক্রয় করছিল বলে তথ্য পায় গোয়েন্দা পুলিশ। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতুকে জাল সার্টিফিকেট ও মার্কশিটসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লালবাগ থানার বড়ভাট মসজিদ এলাকার কাশ্মীরি টোলা লেনের গলির একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী এবং দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির পরিচালক বুলবুল আহমেদ বিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, লালবাগের দুই রুমের বাসাটিতে দামি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, এমব্রস মেশিন স্থাপন করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করা ব্লাঙ্ক মার্কশিট, সার্টিফিকেট চাহিদা অনুযায়ী ব্যক্তিদের নামে ছাপানো হতো। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত অতি সূক্ষ্ম জাল সনদের কাগজ, সার্টিফিকেট, মার্কশিট, প্রশংসাপত্র এবং ট্রান্সক্রিপ্ট ছাপিয়ে এনে বিভিন্ন গ্রাহককে সরবরাহ করতো।
চক্রটি দুই ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, কোনো ধরনের ভেরিফিকেশন হবে না এরকম সার্টিফিকেট, মার্কশিট, প্রশংসাপত্র সরবরাহ করতো চক্রটি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এখন আর নেই, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাল করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে সরবরাহ করতো। এটির জন্য প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে নিতো। দেশে-বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন হবে, এরকম মার্কশিট সার্টিফিকেটও সরবরাহ করতো চক্রের সদস্যরা। এ ধরনের সার্টিফিকেট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নিতো চক্রটি। এতে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অসাধু কর্মকর্তাও। বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, সার্টিফিকেট ও মার্কশিটগুলো বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরবরাহ করা মূল কাগজ দিয়েই তৈরি করা হয়। সেগুলোকে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে অনলাইন ভেরিফিকেশনে সত্যতা মেলে।
জানা গেছে, গ্রেপ্তারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিকমিউনিকেশনে পড়াশোনা করেছেন। চাকরি করেন মোবাইল অপারেটর কোম্পানিতে। গ্রেপ্তার নুরুন্নাহার ছাড়া গ্রেপ্তার বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। জাল সার্টিফিকেট বিক্রির টাকায় প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার বিজনেস ভিসায় বিদেশে গিয়েছে। তার বিদেশ যাতায়াতের পেছনে মানি লন্ডারিংয়ের কোনো বিষয় রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। সিআইডির সহায়তা নেওয়া হবে বলে জানায় ডিবি পুলিশ।
ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘নামিদামি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোর্ডের দায়িত্বশীল অসাধু ব্যক্তির নাম পেয়েছি তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
তবে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্টদের কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।