খুলনা বিভাগ, জেলার খবর, যশোর | তারিখঃ নভেম্বর ৮, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 12182 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : যশোরবাসীর দুর্ভোগ আর প্রতারণার নাম ‘পদ্মবিলা জংশন’। পদ্মাসেতু হয়ে যশোর-ঢাকা রুটে যশোর থেকে এই পদ্মবিলা রেল জংশন দিয়ে ট্রেন চলাচলের তোড়জোড় চলছে। যশোর শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের এই স্টেশন থেকে ঢাকার ট্রেন ধরতে যাওয়া ‘বাস্তবতা বিবর্জিত’ সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করছেন যশোরবাসী। পদ্মবিলা বলা হলেও স্টেশনটি পদ্মবিলায় নয় বরং, যশোর সদর উপজেলার বাইরে বাঘারপাড়া উপজেলায়। এটিকে প্রতারণা বলেও দাবি করা হচ্ছে। এ কারণে পদ্মবিলা জংশনের পরিবর্তে যশোর জংশন থেকে ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচলের দাবিতে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই স্বপ্ন দেখে আসছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হওয়ায় পদ্মা সেতু দিয়ে নড়াইল হয়ে রেলপথে রাজধানীতে পৌঁছানোর যশোরবাসীর সেই স্বপ্ন এখন হাতছোঁয়া দূরত্বে। নতুন এই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হলে রেলপথে যশোর থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১৯৩ কিলোমিটার। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ব্রডগেজ রেললাইন দিয়ে ছুটবে ট্রেন। ঢাকা-ভাঙ্গা হয়ে (রাজবাড়ি-কুষ্টিয়া হয়ে) খুলনা, যশোর ও বেনাপোল রুটে বর্তমানে ট্রেন চলাচল চালু আছে। এতে দূরত্ব কমেছে তিন ঘণ্টার মতো। আর নড়াইল হয়ে সরাসরি রেল সংযোগ চালু হলে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছে যাবে ট্রেন। সড়কপথে যশোর থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা, যা আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক সময়। রেলপথটি ঢাকার কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং নড়াইলের ওপর দিয়ে যশোর গিয়ে শেষ হয়েছে। এই রেললিংক প্রকল্পে যশোর থেকে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হবে।
কিন্তু বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের মানুষের এই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। রেলপথ বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ট্রেনে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার রাধানগর গ্রামের পদ্মবিলা রেল জংশন। যশোর শহরের মূল স্টেশন থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এছাড়া, বেনাপোল থেকে প্রায় ৪০, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর স্টেশন থেকে প্রায় ৫০ এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্টেশন থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে পদ্মবিলার অবস্থান। এই অঞ্চলের মানুষকে ট্রেনে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকায় যেতে হলে ১৮ থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মবিলা স্টেশনে যেতে হবেÑ যা এই অঞ্চলের যাত্রীদের সময় ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে। এ কারণে এই ট্রেনের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। ফলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী রেলযোগাযোগের প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তেমনি বিপুল সংখ্যক যাত্রী হারিয়ে রেলও রাজস্ব আয়ে পেছনের দিকেই ধাবিত হবে। তাই ভোগান্তি লাঘব, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে পদ্মাসেতুর রুটের সঙ্গে বেনাপোল, যশোর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন সংযুক্ত করার দাবি এ অঞ্চলের মানুষের।
সূত্র আরো জানায়, খুব দ্রæতই যশোর-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকার ট্রেনগুলো যশোরের পদ্মবিলা জংশন হয়ে গন্তব্যে যাত্রা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটিকে ‘বাস্তবতা বিবর্জিত’ সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।
কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল জানান, বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য আমরা সরেজমিন পরিদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা থেকে ইজিবাইকে চড়ে যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে লোকাল বাসে চড়ে যশোর-খুলনা মহাসড়কের ঘুনি রাস্তার মোড়ে নেমে ভ্যানে চড়ে পদ্মবিলা জংশনে পৌঁছাই। তিনবার বাহন পরিবর্তন করে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের স্টেশনে পৌঁছাতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টার বেশি। ফলে পদ্মবিলা থেকে ট্রেন ধরে ঢাকায় যেতে হলে দু’ঘণ্টার বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে। ওই সময়ে মণিহার এলাকা থেকে বাসে চড়ে পদ্মাসেতুতে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
কমিটির নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ শেফার্ড বলেন, পদ্মবিলা জংশনের সাথে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। লোকাল বাসসহ তিন বার যেমন বাহন পরিবর্তন করতে হবে, তেমনি ঘুনি রাস্তার মোড় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার গ্রামের বন-জঙ্গল ও ক্ষেত খামারের মধ্যে দিয়ে সড়ক। ফলে এখানে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি থাকবে ঝুঁকিতে।
বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, পদ্মবিলা জংশন নাম দিয়ে যশোরবাসীর সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। পদ্মবিলা গ্রাম যশোর সদর উপজেলার মধ্যে। কিন্তু পদ্মবিলা জংশনটি স্থাপন করা হয়েছে বাঘারপাড়া উপজেলার বাসুয়াড়ি ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের। অর্থাৎ সদর উপজেলার বাইরে অন্য উপজেলায় নিয়ে যশোরের জংশন দেখানো হয়েছে।
যশোর আরএন রোডের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মাসেতু দিয়ে ট্রেন যাত্রা আমাদের যশোর অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে। সকালে যেয়ে কাজ শেষ করে বিকালে বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু বৃহত্তর যশোরের যাত্রীদের স্টেশন করেছে পদ্মবিলাতে। এতোদূর থেকে পদ্মবিলা গিয়ে ট্রেন ধরা সময়-শ্রম-অর্থ সবকিছুই জন্য বিড়ম্বনার।’
বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জাতীয় হকি দলের ম্যানেজার কাওসার আলী বলেন, পদ্মবিলায় এসে যশোরের মানুষ ঢাকার ট্রেন ধরবে, এটি হাস্যকর। ফলে যশোরের মানুষ পদ্মবিলার পরিবর্তে মণিহার থেকে বাসে চড়েই ঢাকায় চলে যাবে। আর দুঃখের বিষয় হলো, পদ্মবিলাকে ভিত্তি করে ট্রেন চলাচল করলে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুরসহ একটি বড় অংশের মানুষের জন্য কোনো ঢাকার ট্রেনই থাকবে না। অথচ এই এলাকার মানুষ এখন তিনটি ট্রেন পান। ফলে সব মিলিয়ে ট্রেন বিপুল পরিমাণ যাত্রী হারাবে। এজন্য আমাদের দাবি যশোরের ট্রেন যশোর জংশন হয়ে যেতে হবে। এই দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আমরা রেল অবরোধসহ আরও কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য হবো।
বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব রুহুল আমীন বলেন, বর্তমানে যশোরবাসী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ৩টি ট্রেন পাচ্ছেন। পদ্মাসেতু রেল প্রকল্প চালু হলে এ রুটে (নড়াইল হয়ে পদ্মা সেতু) মাত্র একটা ট্রেন পাবে। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ রেলসেবা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হবে। পদ্মাসেতু আমাদের স্বপ্নেই থেকে যাবে। তাই বেনাপোল-যশোর-ঢাকা রুটে ২টি ও দর্শনা-যশোর-ঢাকা রুটে ২টি ট্রেন চালু এবং খুলনা থেকে যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা রুটের ট্রেনগুলো বহাল রাখতে হবে। এই দাবি পূরণ হলে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন পদ্মবিলা হয়ে ঢাকায় গেলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যশোরের যাত্রীদের জন্য এই পাঁচটি ট্রেন দিতে হবে।
যশোর রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার আয়নাল হাসান বলেন, ঢাকার ট্রেনের ব্যাপারে এখন কোনো নির্দেশনা তারা পাননি। তবে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নিলে খুলনার ট্রেনগুলো যশোর জংশন হয়েও ঢাকায় যাওয়া সম্ভব।
সুত্র : দৈনিক ইনকিলাব।