ঢাকা অফিস : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দোটানা চলছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েও তা থেকে সরে আসেন। আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ওই পণ্যগুলোর দাম কৃষি মন্ত্রণালয় বেঁধে দেবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘কোনো আলোচনা ছাড়াই বাণিজ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন। দাম বেঁধে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশন।’

অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ৯টি পণ্যের দাম দুই মাসেও নির্ধারণ হয়নি। এতে লাভবান হচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। যার ফলে প্রতিনিয়ত বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে, নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করবে কে?

অপরদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরেও চলছে আরেক তুঘলকি কাণ্ড। এই সংস্থার পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করার কথা বলা হলেও এখানকার মূল্যের সঙ্গে বর্তমান বাজারের কোনো মিল নেই। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে যে বাজার দর দেওয়া থাকে তার চেয়ে অধিক মূল্যে পণ্য কিনতে হচ্ছে মানুষকে। এর আগে দুই বছর সংস্থাটি কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেঁধে দিলেও এখন সেটিও চলমান নেই।

গত ৩০ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রড- এই ৯টি পণ্যের দাম ১৫ দিনের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হবে। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এসব পণ্যের নির্ধারিত মূল্য।’

একইদিন সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডালসহ মোট ৯টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে একমত নই। তিনি বলেন, আমাদের সাথে কোন আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে যা করার ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় করুক।’

এদিকে ওই ৯ পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে না জানিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব আ. গাফ্ফার খান গতকাল বলেন, ‘আমরা কখনও বলিনি পণ্যমূল্য বেঁধে দেওয়ার কথা। যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলে থাকে সেটি তাদের বিষয়। সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী আমরা শুধু বাজারদর মনিটরিং করে প্রতিদিন তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করি। যদি মূল্য অস্বাভাবিক করে কেউ অনৈতিকভাবে লাভবান হতে চায়, বা পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক করে বলে আমাদের দৃষ্টিতে আসে, তাহলে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। জড়িতদের জরিমানা করি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।’

বর্তমান বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অস্বাভাবিক হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে থাকি।’

গত বছর এপ্রিল মাসে ৬টি পণ্যের এবং চলতি বছর মার্চ মাসে ৪০টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের তথ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে মহাপরিচালক বলেন, ‘আগে কে কি করেছে সেটা আমার বিষয় নয়। আমি আসার পর থেকে আইন যা বলছে, সে অনুয়ায়ী কাজ করছি। আইনে মূল্য বেঁধে দেওয়ার এখতিয়ার নেই। মূল্য প্রকাশ করা এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আছে। তা আমরা করছি।’

বাজারমূল্যে ফারাক

গতকাল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেড করপোরেশন অব বাংলাদেশ এবং সরেজমিনে বাজার যাচাই করে দামের বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। সরকারি ওই দুই সংস্থার ওয়েবসাইটে থাকা প্রতিদিনের বাজারদরের সাথে মাঠপর্যায়ের বাজারচিত্রের ১০-১৫ শতাংশ দামের ব্যবধান পাওয়া যায়।

গতকালের টিসিবির বাজার দর

চাল (নাজির মিনিকেট) ৬৫-৮০ টাকা, চাল (পাইজাম লতা) ৫২-৫৬ টাকা, চাল মোটা ৪৭-৫২ টাকা, আটা খোলা ৪৮-৫৫ টাকা, আটা প্যাকেট ৫৫-৬০ টাকা, সয়াবিন তেল ১৮৫-১৯২ টাকা, মুগ ডাল ১২০-১৪০ টাকা, ডাল দেমী ১২৮-১৩৫ টাকা, ডাল আমদানিকৃত ১১০ থেকে ১২০ টাকা, পেয়াজ দেশী ৩৫-৪০ টাকা, পেয়াজ আমদানিকৃত ৩০-৪০ টাকা, রসুন ৭০-৯৫ টাকা, আদা ২০০-২২৫ টাকা, মুরগি ১৫৫-১৭০ টাকা, খাসী ৮৮০-১০০০ টাকা, ডিম হালি ৪৭-৫০ টাকা, লবন ৩৫-৩৮ টাকা, কাচা মরিচ ৭০-১০০ টাকা।

গতকালের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার দর

আমন চাল (সরু) ৬৯-৭৪ টাকা, আমন চাল মাঝারি ৫৫-৫৮ টাকা, আমন চাল মোটা ৪৮-৫০ টাকা, বোরো চাল সরু ৬৮- ৭২ টাকা, বোরো চাল মাঝারি ৫৬- ৫৯ টাকা, বোরো চাল মোটা ৪৬- ৪৮ টাকা, আটা (প্যাকেটজাত) ৫৫- ৫৮ টাকা, খামারের মুরগি ১৬৩- ১৬৮ টাকা, গরুর গোশত ৬৪৭-৬৭৪ টাকা, ফার্মের মুরগির ডিম ৪৫-৪৭ টাকা, চিনি (দেশি) ৮৮- ৯০ টাকা, আয়োডিনযুক্ত লবণ (প্যাকেটজাত) ২৯- ৩৫ টাকা, মুগ ডাল ১২১-১৩০ টাকা, ছোলা ৭২-৭৬ টাকা, সয়াবিন তেল ১৬৯- ১৭২ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৩৭- ৪০ টাকা, রসুন দেশি ৬৭ – ৮০ টাকা, আমদানিকৃত রসুন ১১২-১১৯ টাকা, কাঁচামরিচ ৫৯- ৬৮ টাকা, দেশিআদা ১০০-১১৩ টাকা, আমদানিকৃত আদা ১১২-১২৬ টাকা, পাকা টমেটো ৯৯-১১২ টাকা, খাসির মাংস ৮৮০-৯০০ টাকা।

প্রকৃত বাজারচিত্র

রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে আমাদের প্রতিবেদক পুলক রাজ জানিয়েছেন, গাজর কেজিপ্রতি ১৭০ টাকা, বরবটি কেজিপ্রতি ৬০ টাকা, কাঁচকলার হালি ২৫ টাকা, চিচিঙ্গা কেজিপ্রতি ৬০ টাকা, শসা কেজি প্রতি ৬০ টাকা, মুলা কেজিপ্রতি ৬০ টাকা, পেঁপে কেজিপ্রতি ২৫ টাকা, কাঁচামরিচ কেজিপ্রতি ১০০ টাকা, করলা কেজিপ্রতি ৮০ টাকা, লেবুর হালি ২০ টাকা, জালির পিস ৪০ টাকা, ঢেঁড়শ কেজিপ্রতি ৫০ টাকা, লম্বা বেগুন কেজিপ্রতি ৮০ টাকা, গোল বেগুন কেজিপ্রতি ১২০ টাকা, কাঁকরোল কেজিপ্রতি ৮০ টাকা, টমেটো কেজিপ্রতি ১২০ টাকা, চিনি (ফ্রেশ ও তীর) কেজিপ্রতি ৯৫ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতলজাত) লিটার ১৯০ টাকা, পাঁচ লিটার ৯৪৫ টাকা, পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৫০ টাকা, মুগডাল কেজি ১৫০ টাকা, আদা কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা, রসুন কেজি ১৫০ টাকা, ছোলা ১০০ টাকা, মসুর ডাল চিকন ১৫০ টাকা, মোটা ১২০ টাকা, মিনিকেট কেজিপ্রতি ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল কেজিপ্রতি ৯৫ টাকা, আটাশ চাল কেজিপ্রতি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

গতকালের কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের বাজারদর অনুযায়ী প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮-৫০ টাকা, টিসিবি দর ৪৭-৫২ টাকা, আর বাজারে বিক্রি হচ্ছিল ৬০-৬৩ টাকায়। একইভাবে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি কেজি কৃষি বিপণনের দর অনুযায়ী ১৬৯-১৭২, টিসিবির দর ১৮৫-১৯২, আর বাজারে বিক্রি হয় ১৯০-১৯৫ টাকায়। মুগ ডাল কৃষি বিপণনের দর অনুযায়ী কেজি ১২১-১৩০ টাকা, টিসিবি বলছে ১২০-১৪০ টাকা আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকায়। একইভাবে দেশি পেঁয়াজ কৃষি বিপণনের দর অনুযায়ী প্রতি কেজি ৩৭-৪০ টাকা, টিসিবি বলছে ৩৫-৪০ টাকা আর বাজারে বিক্রি হচ্ছিল ৫০-৫৩ টাকায়।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নাকি কৃষি মন্ত্রণালয় দাম বেধে দেবে সেটা বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে ক্রেতাদের দুর্ভোগ লাঘব হওয়া। সমন্বিতভাবে সকল মন্ত্রণালয় সুষ্ঠুভাবে আইনের প্রয়োগ করলে ক্রেতার দুর্ভোগ লাঘব হবে। দাম নির্ধারণ নিয়ে একজন আরেকজনের ওপর দোষ না চাপিয়ে ক্রেতাদের স্বস্তি দেওয়ার বিষয়ে সকল মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কাজ করা উচিত।