ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহের গ্রামে গ্রামে সম্পতি নিয়ে বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে। জমি নিয়ে বিরোধে চলতি বছরে খুন হয়েছেন ৫ জন। আহত হয়েছেন কয়েক’শ মানুষ। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন গ্রামে জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে সামাজিক অস্থিরতা প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌচেছে যে, জমি নিয়ে ভাইয়ের হাতে ভাই, ভাতিজার হাতে চাচা, সন্তানের হাতে পিতা ও শরীকের লোকজন অহরহ খুন হচ্ছেন। জমির বিরোধ ঠেকাতে পুলিশকে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তারপরও কোন সমাধান নেই। আদালতে বছরের পর বছর চলা মামলা নিস্পত্তি না হওয়ায় যুগ যুগ ধরে বিরোধ জিইয়ে থাকছে। একবার আদালতে মামলা ঠুকে দিলেই যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। ফলে সংঘাতময় ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে পারিবারিক বিরোধ। পুলিশ ও বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চলতি বছরে ঝিনাইদহে জমি নিয়ে বিরোধে খুন হয়েছে ৫জন। এছাড়া সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট বিরোধে আহত হয়েছেন কয়েক’শ মানুষ। এ বছরের ১০ জানুয়ারী জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে আওলাদ হোসেন (৭০) নামে এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করে তার ভাতিজারা। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের মাঠে কাজ করার সময় তার ভাতিজারা কোদালের আচাড়ি দিয়ে পিটিয়ে তাকে হত্যা করে। ১০ কাঠা জমি নিয়ে নিহতের বড়ভাই নিয়ামত আলীর তিন ছেলে জহর আলী, শহিদুল ইসলাম ও মহিদুল ইসলামের সাথে বিবাদ চলছিল। এ নিয়ে একাধিকবার সদর থানা ও বাজারগোপালপু পুলিশ ক্যাম্প সালিশ-বৈঠক হয়। কিন্তু ভাতিজারা কোন শালিস বৈঠক মানেনি। আওলাদ যখন মাঠে কাজ করছিলেন, তখন তার বড় ভায়ের তিন ছেলে মাঠে গিয়ে কোদালের আচাড়ি দিয়ে পিটিয়ে নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে তাকে হত্যা করে। গত ২৮ জানুয়ারি ঝিনাইদহ পৌর এলাকার চরখাজুরা গ্রামের আতিয়ারকে জমি নিয়ে বিরোধর জের ধরে ভাতিজারা মারধর করে। এতে তিনি আহত হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষনা করেন। পুলিশ ও গ্রামবাসির ভাষ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে আতিয়ার ও তার ভাই আলামিনের মধ্যে জমিজাতি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিলো। ঘটনার দিন নিজ জমিতে বাঁশ কাঁটাতে গেলে ভিকটিম আতিয়ার রহমান (৬৫) কে তার আপন ভাতিজা রমজান আলী এলোপাথাড়ি ভাবে মেরে ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর যখম করে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বাজারগোপালপুর গ্রামের মাঠ খুন হন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার লক্ষিপুর রায়পুর গ্রামের রবিউল ইসলামের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (২৮)। পুলিশ তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ ঘটনার সময় জানিয়েছিল সম্পত্তির লোভে হয়তো তাকে পরিবারের কেও হত্যা করতে পারে। গত ১৫ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ভগবাননগর গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষক মকবুল মোল্লা’কে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তার ভাই, ভাতিজা, বোন ও ভাগ্নেরা। জমিটি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছিলেন মকবুল মোল্লা। ওই জমি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চাইছিল ভাই মনিরুল ও বোন পারভীনা। এই দ্বন্দের জেরে ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করা হয়। সেখানে এই ৯ শতক জমির উপর ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেই থেকে মামলাটি বিচারাধীন ছিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। গত ১৫ এপ্রিল ওই জমিতে মকবুল মোল্লার ছেলে একটি ছাপড়া ঘর তৈরি করতে যায়। সেসময় মনিরুল ও পারভীনার সাথে তাদের বাকবিতন্ডা হয়। তারই এক পর্যায়ে তারা লাঠি সোটা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়। মনিরুল, পারভীনা এবং তাহিদুল, আরাফাতসহ কয়েকজন মকবুল মোল্লা’কে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ঢাকার একটি বে-সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মকবুল। গত ২৬ এপ্রিল কালীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হন বড় ভাই ফজলুর রহমান (৭০)। গ্রামবাসি জানায়, দীর্ঘদিন ধরে পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে বড় ভাই ফজলুর রহমানের সাথে ছোট ভাই হাফিজুর রহমানের বিরোধ চলছিল। বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য মঙ্গলবার দুপুরে বারোবাজারে ছোট ভাই হাফিজুরের হোমিও ফার্মেসীতে যান বড় ভাই ফজলুর রহমান। সেখানে দুই ভায়ের কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে ছোট ভাই তার টেবিলে থাকা ছুরি দিয়ে বড় ভাইয়ের বুকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে খুন করে। এছাড়া গত পাঁচ মাসে জমি নিয়ে অর্ধশত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দেওয়ানি মামলার পাশাপাশি ফৌজদরি মামলায় আদালতগুলোতে মামলার স্তুপ জমা হচ্ছে। সম্প্রতি জেলা হরিশংকরপুর, সাধুহাটীর বারোমাইল, কালীগঞ্জের চাপালী, উদয়পুর, হরিণাকুন্ডুর সোনাতনপুর, ডাকবাংলা, কালীগঞ্জের বড়ঘিঘাটি, শৈলকুপার শেখপাড়া, শ্রীরামপুর, শাহাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধে মানুষ হতাহত হয়েছেন। দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতা ও মানুষের নিরাপত্তার ওপর তার প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের করা তিনটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ এই সময়কালের ঘটনা পর্যালোচনা করে তারা বলছে দেশে প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছেন। গবেষণা বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে জমির বিরোধে আড়াই হাজারের বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় ২০২০ সালে, ৬৩৩টি। আগের বছর সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৫’শটি। এই ধরণের ঘটনায় পরিবারের পুরুষরা বেশি জড়িয়ে পড়েন। ফলে কাজকর্ম থেকে অনেকটা সময়ে দূরে থাকতে হয় তাদের, মামলার চালানোর জন্য অর্থ খরচ করতে হয়। এতে জীবনের উপর প্রভাব পড়ে তেমনি জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ঝিনাইদহের অনেক পরিবার আছে তাদের জমি-জমা নিয়ে মামলা চালাতে যেয়ে এখন প্রায় দেউলিয়া। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটী এলাকার শিক্ষক নাছিমা ও শফিকুজ্জামান দম্পত্তি তাদের ৯ শতক বৈধ জমি বুঝে পাচ্ছে না। আদালত থেকে তদন্ত করে জমির কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে বিরোধ নিস্পত্তির উদ্যোগ নিলেও একাধিক আদালতে বার বার প্রতিপক্ষরা মিথ্যা মামলা করায় সমস্যা দিনকে দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের বড় কারণ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও দুর্নীতি। উত্তরাধিকারীরা জমির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়ান, যা মেটানোর কার্যকর ব্যবস্থার ঘাটতি আছে। জমির প্রচুর জাল দলিল হয়। রেকর্ডে ভুল হয়, একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড হয়। বিরোধ তৈরি হয় সীমানা নির্ধারণ নিয়েও। সার্বিকভাবে দুর্বল ব্যবস্থাপনাই বিরোধ ও মামলার কারণ অন্যতম। ঝিনাইদহের আদালতগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে জমি নিয়ে প্রায় ২১ হাজার মামলা বিচারাধীন আছে। এ সব মামলা বছরের পর বছর ঘুরছে। অভিযোগ উঠেছে, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও এক শ্রেনীর আইনজীবীদের অসযোগিতার কারণে মামলা নিস্পত্তিতে দীর্ঘসুত্রিতা প্রকট ভাবে দেখা দিচ্ছে। তবে এ নিয়ে আইনজীবীরা কেও মুখ খুলতে নারাজ। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ জানান, বর্তমান ঝিনাইদহের গ্রামে গ্রামে যে বিরোধ চলছে তার ৭০ ভাগই জমি সংক্রান্ত। দ্রুত মামলা নিস্পত্তি না হওয়ায় মানুষ অসহনীয় ও ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, আদালতের আদেশ ও বিধি নিষেধ পুলিশ যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করলেও মানুষের মধ্যে দ্রæত ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রবণতা কাজ করে। দেওয়ানী মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি করা হলে জেলায় কিান বিরোধ থাকবে না বলেও তিনি মনে করেন।