বিশেষ সংবাদ | তারিখঃ মে ২০, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3397 বার
এবিএম রাজিব : দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও ক্রমাগত কমছে কৃষি জমি। দিন দিন দেশের কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। নতুন বসতভিটা, রাস্তা-ঘাট-অবকাঠামো নির্মাণ, ইটভাটা, কল-কারখানা, নগরায়ণে অধিগ্রহইেই ভূমির বেশি অবক্ষয় হচ্ছে। আর বিদ্যমান ধারায় ভূমি অবক্ষয় অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষি জমি থাকবে না। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ এখনো কৃষি নির্ভর। আর এদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষির উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির উপর নির্ধারিত হয়ে থাকে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। ফলে কৃষি জমির ওপর চাপ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১৮ কোটি হিসেবে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ হেক্টর। কিন্তু প্রতিবছর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা কারণে দেশের প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিবছরই এদেশ থেকে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কমছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি। পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, প্রতি বছর দেশের কৃষি জমির পরিমাণ কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা এক ভাগ হিসাবে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাছে।
সূত্র জানায়, ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্য মতে ১৯৭১ সালে এদেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। কিন্তু বর্তমানে তা মাত্র ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ সালে ১৩ কোটি এবং বর্তমানে ১৮ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় রাজশাহী বিভাগে ১৫ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১ হেক্টর, খুলনায় ১১ হাজার ৯৬ হেক্টর, রংপুরে ৮ হাজার ৭৮১ হেক্টর, বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমি প্রতিবছর অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে। আর চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতিবছর ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সাল পরবর্তী ১২ বছরে দেশে প্রতিবছর ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ কাজের কারণেই প্রতিবছর ৩ হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে। যদিও জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০ অনুসারে কৃষিজমি কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোন অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি আইন আছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৯৮২-৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত ফসলি জমি ছিলো ৯.১৫ মিলিয়ন হেক্টর। ২০১৭-১৮ সালে ফসলি জমির পরিমান কমে ৮.০২ মিলিয়ন হেক্টরে দাঁড়ায়। দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬৯,০০০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য চলে যাচ্ছে। উচ্চহারে জনসংখ্যা ও তাদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাসের জন্য কৃষি, বন ও জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের মোট ভূমির মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এখন ৭৯ দশমিক ৪৬ লক্ষ হেক্টর। আর এর ৫৩ শতাংশ-ই দুই বা তিন ফসলি জমি। তবে অবকাঠামো নির্মাণ, ইটভাটা, কল-কারখানার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং নতুন নতুন বসতভিটা বাড়ার কারণে প্রথমেই অধিগ্রহণ হচ্ছে কৃষি জমি। আর বেসরকারি পর্যায়ে গবেষকরা বলছেন, সেচের আওয়তায় চাষাবাদের জমি ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর। ফসলের নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধানের উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার টন। একই অর্থবছরে মোট দানাদার ফসলের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ৩৬ হাজার টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৩৫ হাজার টন।
এদিকে গত ৩১ মার্চ কৃষি জমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করলে ৩ বছরের কারাদন্ডের বিধান রেখে একটি বেসরকারি বিল সংসদ গ্রহণ করেছে। ওই আইন কার্যকর হলে কেউ কৃষি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করলে অর্থদ- ও কারাদ-ে দ-িত হবেন এমন বিধান রাখা হয়েছে। বিলটি উত্থাপনের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। উত্থাপিত আইনটি কৃষি জমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) আইন-২০২২ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, এদেশে কৃষিজমি রক্ষা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সবার আগে জাতীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও নীতিমালা জরুরি। বাংলাদেশে কৃষি জমির পরিমাণ যে হারে কমছে, তাতে অচিরেই কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রাব পড়বে। যদিও স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানান, ভূমিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।