গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে কতৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি অবাধ,সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠক করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। বৈঠকে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক সংস্কারের পর একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সেই সংস্কারের জন্য ঠিক কতদিন সময় প্রয়োজন তা নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত মাসে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা জানিয়েছিলেন। এদিকে সম্প্রতি আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, একমাত্র প্রধান উপদেষ্টাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন। প্রধান উপদেষ্টা একটি সুবিধাজনক সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিবেন বলে জানান তিনি।

চলমান পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত না হলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনের কৌশল সাজাচ্ছে। আগামীতে তারা ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের তাগিদ দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরীকদের পাশে টানছে দলটি। শরিকদের নিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে জোট হতে পারে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার কথা জানিয়েছেন। দলটির এক সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার পর জাতীয় ঐক্যের শক্তিকে ব্যবহার না করে সেদিন যে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, আগামী দিনে আমরা তার পুনরাবৃত্তি চাই না। এ দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা আগামী দিনে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করবেন। যাতে দেশ তাদের অবদানের সুফল থেকে বঞ্চিত না হয়।”

জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে তারা। বিএনপির পাশাপাশি আন্দোলনের শরিক বিভিন্ন দল ও জোট নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই এসব কর্মসূচি পালন করে।

বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে একাধিক জোট ও দল আন্দোলনে অংশ নেয়। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট অন্যতম। এর বাইরে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), এবি পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ রয়েছে।

বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, অতীতের মতো যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখতে চায় বিএনপি। আগামীতে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামতে চায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই দলটি। এমন বার্তা দিতে ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা। যদিও নির্বাচনের আগে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে দরকষাকষি করবে দলগুলো। বিএনপি তাদের জাতীয় সরকারের অংশীদার করার আশ্বাস দিয়ে অতীতের মতো জোটবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। দলগুলো বিএনপির প্রতি আস্থা রেখে একসঙ্গে পথ চলতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এখন বিএনপি জাতীয় সরকাররের কথা বলছে। তারেক রহমান ব্যক্তিগতভাবে তরুণদের পছন্দ করেন। বিএনপির সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে একসাথে নির্বাচন করার একটা সম্ভবনা আমাদের আছে। আমাদের বর্তমান ঐক্য যদি ভবিষ্যতে বজায় থাকে তাহলে একসাথে নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সরকার গঠন হতে পারে।”

একই সুরে কথা বলেন জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফার ভিত্তিতে বিএনপির সঙ্গে একসাথে আছি। অতীতে আমরা একসঙ্গে ফ্যাসিবাদী বিরোধী আন্দোলন করেছি। এখনো আমাদের পথচলা চলমান আছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব সহসা নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচনী জোট একটি ভিন্ন জিনিস। সেহেতু আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি তাই একসঙ্গে নির্বাচন করারও একটা সুযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগে বিএনপির সঙ্গে একটা সংলাপ হয়েছে সেখানেও এই সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে।”

জোটের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সব দলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সবাই একসঙ্গে আছেন। কয়েক দিন আগেও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক হয়েছে। সেখানে বিএনপি বিজয়ী হলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে চায়- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলমান। যতক্ষণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না আসছে, তা থাকবে।”

এদিকে, আওয়ামী লীগের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী জোট হওয়ার পথ সুগম হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন সেই জোটে জামায়াতের থাকার সম্ভবনা নেই। শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ পেয়েছে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করে দলটির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। নির্বাচন প্রসঙ্গেও তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, যা বিএনপির মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে এবং ২০০১ সালে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তাদের জোট বজায় ছিল। দীর্ঘ এই সময়ে সম্পর্কের উত্থান-পতন হলেও জোট ভাঙেনি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে বিএনপি ও জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির প্রতীকে প্রার্থী হন, কিন্তু ওই নির্বাচনের পর দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল দেখা দেয়। ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দল জোট ভেঙে দেয়। তবে সরকারের পতনের আন্দোলনে তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ঐক্য ছিল।

সরকার পতনের পর বিএনপি জামায়াতের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ পায়। বিএনপি নেতারা মনে করেন, জামায়াত পরিকল্পিতভাবে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। ৫ আগস্টের পর জামায়াত উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। বিএনপির মতো বৃহত্তর দলের বিরুদ্ধে মাঠে প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনের পদ-পদবিতে দলের সমর্থিত পেশাজীবীদের নিয়োগে প্রতিযোগিতা করছে। তারা আদালতে সরকারি আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি জামায়াতকে বাইরে রেখেই আগামী নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে। ভোটের মাঠে জামায়াতের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট হওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আসন সমন্বয় করে বিজয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক মিত্র দলটির বর্তমানে বিএনপির রাজনৈতিক মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, “নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর আমরা ইসলামী দলগুলোর সাথে কোনো জোট করব কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। আর বিএনপির ব্যাপারেও আমাদের একই অবস্থান। এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।”

এবিষয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন রাজনৈতিক দল। তারা তাদের মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে। নির্বাচনী জোট সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।”