সানজিদা আক্তার সান্তনা, যশোর অফিস : সারা জীবন সংগ্রামী, অকুতোভয়, গনতন্ত্রী, মানবতাবাদী, মুক্তিযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যশোরের প্রবীন রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা বারবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা জনাব তবিবর রহমান সরদারের ১২ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৩ এপ্রিল ২০২২। ২০১০ ইং এই ক্ষনজন্মা প্রবাদ প্রতীম পুরুষ যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনারী কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৫ টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তবিবর রহমান সরদার বঙ্গবন্ধু কতৃক ঘোষিত :-(“বাংলায় মজিবর শার্শায় তবিবর”:- খ্যাত এই কিংবদন্তী ক্ষনজন্মা রাজনৈতিক ১৯৩২ সালের ১ মে যশোর জেলার শার্শা থানাধীন বারিপোতা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। মরহুম মতিয়ার রহমান সরদার ও মরহুমা রাবেয়া খাতুনের জৈষ্ঠ্য পুত্র তবিবর রহমান সরদার এর বাল্যকাল কেটেছে বারিপোতা গ্রামে। শিক্ষার হাতে খড়ি নাভারন বুরুজবাগান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পন্ন করেন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা মেট্রিকুলেশন। এরপর খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল (বি,এল) কলেজ থেকে সম্পন্ন করেন উচ্চমাধ্যমিক ও বি,এ পরীক্ষা। ছাত্রজীবন থেকে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে। ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা। ব্যবসা দিয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। মনুষ্য কল্যাণ ও রাজনীতি তাকে খুব টানে। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের শার্শা থানার আহবায়ক এবং মহকুমার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত যশোর জেলার আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ২০০২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৮ সালে নির্বাচিত হোন ইউপি সদস্য। ১৯৫৮ সালে নির্বাচিত ইউপি সদস্য হিসেবে শুরু হয় তার জনপ্রতিনিধত্ব। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন বিপুল ভোটের ব্যবধানে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন ও ৬৯ গণঅভ্যুথানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষনজন্মা এক রাজনৈতিক শহীদ মশিউর রহমানের স্নেহাস্পদ তবিবর রহমান সরদার ১৯৭০ সালে এম,সি,এ (গণ পরিষদ সদস্য) হিসেবে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে নির্বাচিত হোন। স্বাধীনতা পরবর্তী শার্শা উপজেলার প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। বাংলাদেশের সপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যশোর এর এক সমাবেশে তাকে “বাংলায় মুজিবর শার্শায় তবিবর” খ্যাত স্লোগান/উপাধী দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই তিনি ভারতে চলে যান এবং সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং করতেন। তাদের দেখভাল করতেন। শরর্নার্থী শিবিরের খাবার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
এই রণসৈনিক তার সঠিক কর্ম ও স্থানটি খুজে পান ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতাকামী এই মানুষটি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের পেট্রাপোলে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট এই সংগঠক ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে যশোর টাউন হল ময়দানের এক জনাকীর্ন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। এরপর ১৯৭৩, ৯১ ও ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শার্শা এলাকায় বহু স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুঃসময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যার পর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, এর হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাথার চুল কাটবেন না। তিনি তা রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে হজব্রত পালন করতে গিয়ে ধর্মীয় কারণে তিনি মাথার চুল কেটেছিলেন এবং পরবর্তীতে তা আবারও রাখেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কান্ডারির মতো ছিলেন। আর সেই সময় দলে গ্রুপিং থাকলেও তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। নতুন প্রজন্মের আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জানেন না তবিবর রহমান সরদার কেমন মানুষ ছিলেন। কারণ, তিনি যাঁদের সাথে রাজনীতি করেছেন, তাঁদের অনেকে গত হয়েছেন বেশ আগেই। তবে যশোরের আওয়ামী লীগ শুধু নয়, প্রতিটি দলের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
৪ বার সংসদ সদস্য থাকার সময় শার্শা এলাকায় যত স্কুল কলেজ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সব গুলো প্রত্যক্ষ ভাবে তার তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ কলেজ, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজ, নাভারন ডিগ্রি কলেজ, বুরুজবাগান উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ধলদা টিআরএস (তবিবর রহমান সরদার) মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বুরুজবাগান গালর্স হাইস্কুল, গোর্কণ দাখিল মাদ্রাসা থেকে শুরু করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তিনি তৈরি করেছেন ও অনুদান দিয়েছেন।

আজন্ম রাজনীতিক এই ব্যক্তি যেমন ছিলেন বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী অন্যদিকে তিনি ছিলেন বাক সংযমী। তিনি চাইতেন কেউ যেন তার কথায় কষ্ট না পায় সেজন্য তিনি সর্বদা ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। সেজন্য তার জানাযার দিন সমাজের সাধারন মানুষ সহ অন্য ধারার রাজনীতিক সকলেই উপস্থিত ছিলেন তার জানাযায়। ভূয়সী প্রসংসা তার বন্যাঢ্য কর্মজীবন ও মাগফেরাত কামনা করেছেন।

প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান সহ বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ প্রমুখ রাজনীতিকদের সহিত তাঁর ছিল সদ্ভাব। তাঁদের কাছ থেকে যেমন পেয়েছেন সম্মান তেমনি আজীবন তাঁদের সম্মান করেছেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয়ের মত গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি নিয়োগ করেন।