জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ আগস্ট ২০, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 5180 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : অবিশ্বাস্য। অকল্পনীয়। শতাংশের হারে শত থেকে সহস্রাধিক গুণ সম্পদ বেড়েছে। এমনকি কারও বেড়েছে লাখ গুণ। বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও বাস্তবে মন্ত্রী-এমপিরা নিজেকে বিত্তশালী করতেই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। গত ১৫ বছরে তাদের প্রায় সবাই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয়ে শীর্ষে থাকা ৪১ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পর্যায়ক্রমে এদের সবার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করবে সংস্থাটি। এরই মধ্যে তিনজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে নিশ্চিত করেছেন দুদক সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয়ের যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের অনুসন্ধান করার উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মনে আশা জাগাবে। কিন্তু দুদকের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা এই উদ্যোগে দূর হবে না।
কারণ অনেক আগে থেকেই মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচিত ছিল। গণমাধ্যমে তা প্রচার-প্রকাশও হয়েছে। আমরাও এ নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছি, কিন্তু দুদক থেকে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একযোগে ক্ষমতাচ্যুত এত সংখ্যক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে এটা করা হলে দুদক সাধুবাদ পেত। এখন এটা যেন আগের মতো লোক দেখানো না হয়। মানুষ দেখতে চায় দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় দুদক ঢেলে সাজানোর যে দাবি উঠেছে এই উদ্যোগের মাধ্যমে তা যেন আড়াল না হয়। দুদক ঢেলে সাজানো অপরিহার্য।
জানা গেছে, গত ১৫ বছরে রেকর্ড পরিমাণ ২,৪৩,৫১৩% অস্থাবর সম্পদ বাড়িয়ে শীর্ষস্থানে আছেন রাজশাহী-৪ আসনের এমপি এনামুলক হক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৩২৪% সম্পদ বাড়িয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। এরপর যথাক্রমে সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির ৭৬৯২%, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৬৩৫০%, আইন ও খাদ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা কামরুল ইসলামের ৫৩৯০%, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ৪৭২৩%, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ৪৬৮৩%, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের এমপি জিয়াউর রহমানের ৪৬৮২% ও ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজীর আহমেদের ৮১৯৭% সম্পদ বেড়েছে।
আরও জানা গেছে, আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ মন্ত্রী-এমপি আছেন দুদকের তালিকায়। এদের মধ্যে পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি জাতীয় পার্টি (জেপি) নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ৭১১৬%, মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই আলম চৌধুরী লিটনের ৫৬৯৬%, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খানের ৪৬৯৭%, নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৪১৩১%, জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ২৮৯৫%, বাগেরহাট-১ আসনের হেলাল উদ্দিনের ২৭৬৭%, রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের ২৭৫৬% ও গাজীপুর-২ আসনের জাহিদ আহসান রাসেলের ২৫৪৫% আয় বেড়েছে।
গত ৫ বছরের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির তালিকায় পুরোনোদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন মুখ। এই তালিকায় ৯ জনের নাম রয়েছে। এখানেও ৫৪৭০% অস্থাবর সম্পদ বাড়িয়ে শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রেখেছেন রাজশাহীর এমপি এনামুল হক। এরপর যথাক্রমে নোয়াখালী-৩ আসনের মামুনুর রশীদ কিরণের ৩০৬৫%, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের ১৯১৩%, খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ১০৫৪%, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিববুর রহমানের ১০২৪%, মেহের আফরোজ চুমকির ৮২৭%, কুষ্টিয়া-১ আসনের আ ক ম সরওয়ার জাহানের ৫৭৪%, ময়মনসিংহ-১১ আসনের কাজিম উদ্দিন আহমেদের ৫৪৩% ও যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য্যরে ৪৮৬% অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে।
জানা গেছে, গত ১৫ বছরে অস্বাভাবিক স্থাবর সম্পদ বাড়ার তালিকায় আছেন আরও ১৬ জন। তাদের মধ্যে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৬৩৫০%, গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ২৮৫৮%, পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ২৭০৩%, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের ২১৬৯%, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হমায়ুনের ৯৮২%, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ৭৮৩%, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের ৪৯৩% ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ১২৯% সম্পদ বেড়েছে।
এছাড়া ঢাকা-২ আসনের এমপি বেনজীর আহমেদের ২২৩৮%, কুষ্টিয়া-১ আসনের সরওয়ার জাহানের ২২০০%, রংপুর-৪ আসনের টিপুর মুন্সীর ২১৩১%, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর ২০৭৪%, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের ১৯৭২%, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের ১৮০৮%, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দিন তরফদারের ১৪৯৪%, দিনাজপুর-৪ আসনের কাজী নাবিল আহমেদের ১০৩৯% সম্পদ বেড়েছে।
জানা গেছে, সবশেষ গত ৫ বছরে অস্বাভাবিক আয় বৃদ্ধির তালিকায় আছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। এদের প্রতিজনের সর্বনিু ১৩২% থেকে সর্বোচ্চ ১০৬৩% সম্পদ বেড়েছে।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব মন্ত্রী-এমপির সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে একটি তালিকা ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তসংবলিত একটি আবেদন দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন। রোববার জমা দেওয়া ওই আবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রী-এমপিদের সীমাহীন এই আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি দুর্নীতি ছাড়া সম্ভব হয়নি। অনেক মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বাড়ার চিত্র রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এর মধ্যে অনেক মন্ত্রী-এমপির সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশিত হলেও তা অনুসন্ধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করে। জনমনে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। দুদক থেকে অনেক সময় মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের অনুসন্ধানের কথা বলা হলেও কার্যত তা ছিল আইওয়াশ।
আবেদনকারী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি এরই মধ্যে গ্রেফতার হলেও দুদক তাদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছিল না। এ কারণেই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক ও আইনজীবী হিসাবে আমি তাদের সম্পদের অনুসন্ধানের আবেদন জমা দিই। এসব মন্ত্রী-এমপির নির্বাচনি হলফনামা থেকে যে কেউ চাইলেই তাদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমপি-মন্ত্রীদের অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ করা হলেও দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, আবেদনটি পাওয়ার পর সোমবার বিকালে তালিকায় থাকা মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। পর্যায়ক্রমে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনজন পরিচালকের নেতৃত্বে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান টিম তালিকায় থাকা মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুত্র: দৈনিক যুগান্তর।