০১:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

পানছড়ির ঐতিহাসিক শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে ১৯তম দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপন

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট: ০১:২৮:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
  • /

খোকন বিকাশ ত্রিপুরা জ্যাক,খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা খাগড়াছড়ির পানছড়ির ঐতিহাসিক শান্তিপুর অরণ্য কুটির শনিবার পরিণত হয়েছিল ধর্মীয় ভক্তি, শান্তি ও পুণ্যের মিলনমেলায়।
ভোরের প্রথম আলোয় বনে ভেসে আসে পঞ্চশীল পাঠের সুমধুর ধ্বনি—এর মধ্য দিয়েই সূচনা হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম দানোত্তম উৎসব,১৯তম কঠিন চীবর দান।

বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় আয়োজিত এই দিনব্যাপী উৎসবে হাজারো উপাসক-উপাসিকা, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভক্তজন একত্র হন শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে। আগের রাতে চলে ঐতিহ্যবাহী বেইন বুনা অনুষ্ঠান, যেখানে নারীরা পরম নিষ্ঠায় তুলা থেকে সুতা তৈরি করেন—এ যেন পরের দিনের মহাদানের প্রস্তুতি।

দানের চূড়ান্ত রূপ—চীবর বুনা একদিনে
কঠিন চীবর দান উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো মাত্র ২৪ ঘণ্টায় চীবর তৈরি।তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড়—আর সেই কাপড় বুনে গড়ে ওঠে ভিক্ষুদের পরিধেয় চীবর।
এ শ্রমসাধ্য দানের পুরো প্রক্রিয়াটি একদিনেই সম্পন্ন করতে হয়, যা ভক্তি, ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের অনন্য প্রতীক।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মতে, গৌতম বুদ্ধের অনুজ্ঞা অনুযায়ী মহা উপাসিকা বিশাখা প্রথম এই দানের রীতি প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীকালে “দানোত্তম দান” হিসেবে খ্যাত হয়।

চীবর দানের আগে অনুষ্ঠিত হয় বুদ্ধ মূর্তি দান, সংঘ দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, কল্পতরু দান ও পিণ্ডু দানসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্টান।পঞ্চশীল গ্রহণ শেষে উপাসক-উপাসিকারা মনোনিবেশ করেন স্বধর্ম শ্রবণে, যেখানে ভিক্ষুগণ ধর্মদেশনা প্রদান করেন মানবকল্যাণ ও নৈতিক জীবনের গুরুত্ব নিয়ে।

ধর্মীয় অনুশাসনের মাহাত্ম্য ও প্রজ্ঞার বাণী

দিনব্যাপী ধর্মদেশনা প্রদান করেন রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত প্রজ্ঞালংকার মহাথেরো।

তিনি বলেন,“কঠিন চীবর দান শুধু ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র দান নয়; এটি ভক্তির শুদ্ধ প্রকাশ, ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি। এই দানের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের অন্তরের অজ্ঞানতা দূর করে মৈত্রীর পথে এগিয়ে যায়।”

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—শান্তিপুর অরণ্য কুটিরের অধ্যক্ষ ভদন্ত শাসনারক্ষিত মহাথেরো, রাজবন বিহারের আবাসিক ভিক্ষু ভদন্ত অগ্রজ্যোতি মহাথেরো, সারনাথ বনবিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত আর্য্য জ্যোতি মহাথেরো, মৈত্রীপুর ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ বিমলানন্দ মহাথেরো, গিরিখণ্ড অরণ্য কুটিরের অধ্যক্ষ ভদন্ত উপসেন মহাথেরো, মুবাছড়ি বনবিহারের অধ্যক্ষ সুমনাতিষ্য মহাথেরো, মিলনপুর বনবিহারের অধ্যক্ষ শ্রদ্ধাতিষ্য মহাথেরোসহ বিভিন্ন বিহারের ভিক্ষু ও বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ।

মিলনমেলা ও পুণ্যের অর্চনা
উৎসব প্রাঙ্গণজুড়ে ছিল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি উৎসবমুখর পরিবেশ।বৃদ্ধ, যুবা, নারী-পুরুষ সবাই একত্র হয়ে হাতে পদ্মফুল, ফলমূল ও ধূপবাতি নিয়ে উপস্থিত হন দানের মহাসাগরে।বৌদ্ধ গাথা ও ভিক্ষুদের করুণ সুরের সংগীতে ভেসে বেড়ায় অরণ্য কুটিরের প্রতিটি কোণ।
দিনের শেষে যখন চীবর বুনন সম্পন্ন হয়ে তা ভিক্ষু সংঘের হাতে অর্পণ করা হয়, তখন উপস্থিত জনতার চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির পরম ছোঁয়া।

শান্তির অন্বেষায় এক মহাদান
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজে কঠিন চীবর দান উৎসব কেবল ধর্মীয় ঐতিহ্য নয়—এটি সংযম, ত্যাগ ও মৈত্রীর এক অদ্বিতীয় অনুশীলন।ভক্তদের বিশ্বাস, একনিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে এই দান সম্পন্ন করলে সংসার জীবনের ক্লেশ দূর হয়ে শান্তি ও মঙ্গল নেমে আসে।

পাহাড়ের সবুজ, প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে তাই দিনভর মুখরিত ছিল পুণ্যের স্পর্শে।”

Please Share This Post in Your Social Media

পানছড়ির ঐতিহাসিক শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে ১৯তম দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপন

আপডেট: ০১:২৮:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

খোকন বিকাশ ত্রিপুরা জ্যাক,খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা খাগড়াছড়ির পানছড়ির ঐতিহাসিক শান্তিপুর অরণ্য কুটির শনিবার পরিণত হয়েছিল ধর্মীয় ভক্তি, শান্তি ও পুণ্যের মিলনমেলায়।
ভোরের প্রথম আলোয় বনে ভেসে আসে পঞ্চশীল পাঠের সুমধুর ধ্বনি—এর মধ্য দিয়েই সূচনা হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম দানোত্তম উৎসব,১৯তম কঠিন চীবর দান।

বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় আয়োজিত এই দিনব্যাপী উৎসবে হাজারো উপাসক-উপাসিকা, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভক্তজন একত্র হন শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে। আগের রাতে চলে ঐতিহ্যবাহী বেইন বুনা অনুষ্ঠান, যেখানে নারীরা পরম নিষ্ঠায় তুলা থেকে সুতা তৈরি করেন—এ যেন পরের দিনের মহাদানের প্রস্তুতি।

দানের চূড়ান্ত রূপ—চীবর বুনা একদিনে
কঠিন চীবর দান উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো মাত্র ২৪ ঘণ্টায় চীবর তৈরি।তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড়—আর সেই কাপড় বুনে গড়ে ওঠে ভিক্ষুদের পরিধেয় চীবর।
এ শ্রমসাধ্য দানের পুরো প্রক্রিয়াটি একদিনেই সম্পন্ন করতে হয়, যা ভক্তি, ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের অনন্য প্রতীক।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মতে, গৌতম বুদ্ধের অনুজ্ঞা অনুযায়ী মহা উপাসিকা বিশাখা প্রথম এই দানের রীতি প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীকালে “দানোত্তম দান” হিসেবে খ্যাত হয়।

চীবর দানের আগে অনুষ্ঠিত হয় বুদ্ধ মূর্তি দান, সংঘ দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, কল্পতরু দান ও পিণ্ডু দানসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্টান।পঞ্চশীল গ্রহণ শেষে উপাসক-উপাসিকারা মনোনিবেশ করেন স্বধর্ম শ্রবণে, যেখানে ভিক্ষুগণ ধর্মদেশনা প্রদান করেন মানবকল্যাণ ও নৈতিক জীবনের গুরুত্ব নিয়ে।

ধর্মীয় অনুশাসনের মাহাত্ম্য ও প্রজ্ঞার বাণী

দিনব্যাপী ধর্মদেশনা প্রদান করেন রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত প্রজ্ঞালংকার মহাথেরো।

তিনি বলেন,“কঠিন চীবর দান শুধু ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র দান নয়; এটি ভক্তির শুদ্ধ প্রকাশ, ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি। এই দানের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের অন্তরের অজ্ঞানতা দূর করে মৈত্রীর পথে এগিয়ে যায়।”

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—শান্তিপুর অরণ্য কুটিরের অধ্যক্ষ ভদন্ত শাসনারক্ষিত মহাথেরো, রাজবন বিহারের আবাসিক ভিক্ষু ভদন্ত অগ্রজ্যোতি মহাথেরো, সারনাথ বনবিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত আর্য্য জ্যোতি মহাথেরো, মৈত্রীপুর ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ বিমলানন্দ মহাথেরো, গিরিখণ্ড অরণ্য কুটিরের অধ্যক্ষ ভদন্ত উপসেন মহাথেরো, মুবাছড়ি বনবিহারের অধ্যক্ষ সুমনাতিষ্য মহাথেরো, মিলনপুর বনবিহারের অধ্যক্ষ শ্রদ্ধাতিষ্য মহাথেরোসহ বিভিন্ন বিহারের ভিক্ষু ও বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ।

মিলনমেলা ও পুণ্যের অর্চনা
উৎসব প্রাঙ্গণজুড়ে ছিল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি উৎসবমুখর পরিবেশ।বৃদ্ধ, যুবা, নারী-পুরুষ সবাই একত্র হয়ে হাতে পদ্মফুল, ফলমূল ও ধূপবাতি নিয়ে উপস্থিত হন দানের মহাসাগরে।বৌদ্ধ গাথা ও ভিক্ষুদের করুণ সুরের সংগীতে ভেসে বেড়ায় অরণ্য কুটিরের প্রতিটি কোণ।
দিনের শেষে যখন চীবর বুনন সম্পন্ন হয়ে তা ভিক্ষু সংঘের হাতে অর্পণ করা হয়, তখন উপস্থিত জনতার চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির পরম ছোঁয়া।

শান্তির অন্বেষায় এক মহাদান
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজে কঠিন চীবর দান উৎসব কেবল ধর্মীয় ঐতিহ্য নয়—এটি সংযম, ত্যাগ ও মৈত্রীর এক অদ্বিতীয় অনুশীলন।ভক্তদের বিশ্বাস, একনিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে এই দান সম্পন্ন করলে সংসার জীবনের ক্লেশ দূর হয়ে শান্তি ও মঙ্গল নেমে আসে।

পাহাড়ের সবুজ, প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে তাই দিনভর মুখরিত ছিল পুণ্যের স্পর্শে।”