আইন ও আদালত, শিক্ষাঙ্গন | তারিখঃ এপ্রিল ২৬, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 12701 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর তা অন্তত ২০০ পরীক্ষার্থীর কাছে বিক্রির চুক্তি করেছিলেন অসীম গাইন নামে এক ব্যক্তি। তাদের থেকে ‘চাকরি নিশ্চিত’ করা পর্যন্ত ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকায় এ চুক্তি হয়। প্রথম দফায় দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিলেও বাকি টাকার জন্য চেক নিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এ অসীম গাইনের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈরের কদমবাড়ী ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে। তিনি ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী আপন ভাতিজা জ্যোতির্ময় গাইন ও তার বন্ধুদের দিয়ে চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
গত ২৯ মার্চ প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষা হয়। এ পরীক্ষায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) ২১ জেলার ৩ লাখ ৪৯ হাজার ২৯৩ পরীক্ষার্থী অংশ নেন। তবে পরীক্ষার দিনই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে গিয়ে মাদারীপুরের পাঁচটি কেন্দ্র থেকে সাতজন এবং রাজবাড়ীর একটি কেন্দ্র থেকে এক পরীক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। এর পরই বেরিয়ে আসে অসীম গাইনের নাম। ঘটনাটি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ তদন্ত শুরু করে। এরই মধ্যে গত ২১ এপ্রিল রাতে ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর।
গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলার প্রথম পাতায় ‘মাদারীপুরে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ঢাকায় সমাধান’ শিরোনামে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর গতকালই ঢাকা মহানগর ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের তথ্য জানায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল নিজ কার্যালয়ে জানান, ওই প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা পলাতক অসীম গাইন। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। পাশাপাশি মানব পাচারেও জড়িত ওই ব্যক্তি। অবৈধ টাকায় বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, অসীম গাইন প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। এরপর সেটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তার ভাতিজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জ্যোতির্ময় গাইনের কাছে পাঠাতেন। জ্যোতির্ময় তার বন্ধুদের নিয়ে জগন্নাথ হলে বসে প্রশ্নের সমাধান করে তা অসীমের মোবাইল ফোনে পাঠাতেন। অসীম তা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, মাদারীপুর জেলা পুলিশের তথ্যে তাদের সাইবার ইউনিট প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত শুরু করে। এরপর চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিস্তারিত জানিয়েছেন। জব্দ করা ডিভাইস ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া গেছে, পরীক্ষার আগেই অসীম গাইন প্রশ্ন পেতেন। এখন এ প্রশ্ন তিনি কোথা থেকে পেতেন, সেই তদন্ত চলছে। পুরো বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ সূত্র জানায়, মাদারীপুর পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে তারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সমাধান সেলের হোতা ঢাবি ছাত্র জ্যোতির্ময় গাইন ও তার বন্ধু ঢাবি ছাত্র সুজন চন্দ্র রায়, মনীষ গাইন, পংকজ গাইন ও লাভলী মণ্ডলকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে পংকজ, লাভলী ও মনীষ গাইনের স্ত্রী ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন। মনীষের স্ত্রীর তিন মাসের সন্তান থাকায় মানবিক কারণে এখনই আইনের আওতায় আনা হয়নি। ওই ঘটনায় আরও অনেকেই পলাতক রয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গ্রেপ্তার জ্যোতির্ময় জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তার চাচা অসীম গাইন পরীক্ষার দিন সকালে (২৯ মার্চ) হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রশ্নপত্র পাঠান। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তার নেতৃত্বে জগন্নাথ হলের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের ২২৪ নম্বর কক্ষে বসে তারা প্রশ্নপত্র সমাধান করে দ্রুত তা চাচার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠিয়ে দিতেন। পরে চাচা অসীম গাইন চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে সমাধান পাঠান। এজন্য চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীরা আগেই কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে অবস্থান করতেন।
গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জ্যোতির্ময় জানান, প্রশ্নপত্র সমাধানে তার সঙ্গে সুজন, বেনু ও রনি বিশ্বাস ছাড়াও বুয়েটের আরও চার ছাত্র ছিলেন। ওই ছাত্রদের তিনি নাম জানেন না। তার চাচা তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য ৪৬তম বিসিএস (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল গ্রেপ্তারদের। কিন্তু অপকর্ম করে তারা এখন গোয়েন্দা হেফাজতে। বুয়েটের যে চার ছাত্রের বিষয়টি এসেছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম কালবেলাকে বলেন, পরীক্ষার দিনই জেলা গোয়েন্দা পুলিশ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ডিভাইসসহ সাত শিক্ষার্থীকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অসীম গাইনের নাম বেরিয়ে আসে। ওই ঘটনায় আটক সাত পরীক্ষার্থী, অসীম গাইনসহ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে গ্রেপ্তারের আগেই অসীম গাইন আগাম জামিন নেন। তিনি পালিয়ে বিদেশ চলে গেছেন বলে তথ্য রয়েছে। মাদারীপুর থেকে গ্রেপ্তার পরীক্ষার্থীরাও জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
অবশ্য মাদারীপুর জেলা পুলিশ ও ঢাকার গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার জ্যোতির্ময় গাইনের আপন বড় ভাই ও পলাতক অসীম গাইনের ভাতিজা সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে ঢাকায় একটি লিগ্যাল অফিসে কর্মরত। মূলত তার প্রভাবেই ওই আসামিদের জামিন হয়। এ ছাড়া অসীম গাইন আগাম জামিন নেওয়ার দিন মাদারীপুরের একজন জনপ্রতিনিধির আপন ছোট ভাইয়ের গাড়িতে করে আদালতে হাজির হন। পুলিশের পক্ষ থেকে তার রিমান্ড আবেদন করা হলেও তা খারিজ হয়। এরপর ওই জনপ্রতিনিধির ভাইয়ের গাড়িতে করেই তিনি আদালত চত্বর ছাড়েন।
এদিকে গতকাল ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মনীষ গাইন, পংকজ গাইন ও লাভলী মণ্ডল। জ্যোতির্ময় গাইন ও সুজন চন্দ্র রায়ের প্রথম দফা রিমান্ড শেষে গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে ফের দুদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সুত্র : কালবেলা