ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহের সিও এনজিও’র বিরুদ্ধে ব্লাঙ্ক চেক নিয়ে চাকরী ও ঋন প্রদানের বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জনপ্রতিনিধি, সুশিল সমাজ ও গনমাধ্যমকর্মীরা।

রোববার বিকালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সভায় অংশ গ্রহন করা গনমাধ্যমকর্মীরা। সভার সভাপতি জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম ভুক্তভোগী কারো অভিযোগ থাকলে প্রমানসহ জমা দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেন।

সভায় ঝিনাইদহের বেসরকারি সংস্থা সিও (SEHEO) সহ বিভিন্ন এনজিও’র অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বক্তব্য দেন সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সভাপতি এম রায়হান ও বিটিভির জেলা প্রতিনিধি পিন্টু লাল দত্ত। তারা অভিযোগ করেন, এনজিও গুলো তাদের খ্যাতির আড়ালে ভয়ঙ্কর কর্মী নির্যাতন ও অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতারণার করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সিও এনজিও চাকরীর সময় জমা রাখা ব্লাংক চেক নিয়ে পরবর্তীতে ইচ্ছামতো টাকার অংক বসিয়ে করছেন চেক ডিজ অনারের মামলা। ঝিনাইদহসহ আশপাশ জেলার বিভিন্ন আদালতে সিও এনজিও’র দায়েরকৃত এমন সহস্রাধীক মামলা বিচারাধীন আছে। এ সব মামলায় বেশির ভাগই আসামী নারী ঋন গ্রহীতা ও পুরুষ চাকরীজীবী।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ায় কয়েক কোটি টাকা ব্যায়ে সুউচ্চ বহুতল ভবন হাকিয়ে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এক সময় হাটে হাটে কাঁচা তরকারি বিক্রেতা সামছুল আলম।

অভিযোগ উঠেছে সিও সামছুলের ব্যবসা মুলত সুদ নিয়ে। ঋন দিয়ে উচ্চ হারে তিনি সুদ আদায় করেন। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ঋন দেবার সময় জমা রাখা ব্লাঙ্ক চেক ও তিন’শ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের বুনিয়াদে আদালতে মামলা করেন। এ ভাবে তিনি হাজারো ঋন গ্রহীতাকে পথে বসিয়েছেন বলে কথিত আছে। সিও’র দায়ের করা মামলার আসামিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই এক সময় সিও’তে চাকরি করতেন। চাকরিতে যোগদানের সময়, ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জামানত, ব্লাঙ্ক চেক জমা ও ননজুডিশিয়াল ট্যাম্পে চুক্তি করতে হয়। চাকরি ছাড়ার সময় গ্রাচুয়িটি ও অন্যান্য ফান্ডের টাকা চাইতে গেলে কপালে জোটে আর্থিক অনিয়মের মামলা।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার উমাপুর (নতুনপাড়া) গ্রামের জামাত আলীর ছেলে বিপ্লব হোসেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে সেলিম রেজা, হরিণাকুÐু উপজেলার পারফলসি গ্রামের মৃত আক্কাস আলীর ছেলে মতিয়ার রহমান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নাথকুন্ডু গ্রামের বাহাদুর শেখের মেয়ে চামেলী আক্তার সীমা, কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে মামুনসহ অসংখ্য কর্মী জামানতের টাকা, জমা রাখা ব্যাংক চেক ফেরত চেয়ে মামলায় জড়িয়ে ফতুর হয়ে গেছেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আমিরুল ইসলাম জানান, তিনি বাদি হয়ে মেহেরপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে সিও’র মালিক সামছুলের বিরুদ্ধে চিটিং মামলা করেন। বর্তমানে মেহেরপুর সদর সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের মামলায় (সিআর ১৩২/২২) সিও’র নির্বাহী পরিচালক সামছুল আলমের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে না। এদিকে, সিও’র পক্ষ থেকে আমিরুল ইসলামের নামে ঝিনাইদহে আদালতে চাকরির সময় জমা নেওয়া চেক, ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দিয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছে। সেই মামলায় ঝিনাইদহের আদালত বিবাদি আমিরুল ইসলামের পক্ষে রায় দিলে সিও সামছুল উচ্চ আদালতে আপিল করেন। উচ্চ আদালতে আমিরুল ইসলামের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে পচ্ছন্দ মতো উকিল নিয়োগ করে সামছুল আলম ধরা খেয়েছেন।

আমিরুল ইসলাম বলেন, আমি সিওতে ব্র্যাঞ্চ মানেজার পদে চাকরী করতাম। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আমার জামানত, ব্লাঙ্ক চেক, ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও সার্টিফিকেট ফেরত চাইলে উল্টো আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় আমি নির্দোষ বলে প্রমাণিত হয়েছি। গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থানার সুইগ্রামের মতিয়ার রহমানের ছেলে এবিএম মাহবুবুর রশিদ জানান, তিনি সিও’তে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন।

২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাত তিনটার দিকে সিও হেড অফিস থেকে বাড়িতে কল দিয়ে বলা হয় মাহবুবুর রশিদ ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করেছেন। পরিবারকে বলা হয় অনিয়মের টাকা দিয়ে তাকে নিয়ে যেতে। মাহবুবুর রশিদের ছেলে মারুফ হাসান বলেন, ওই দিন বিকাল ৫ টার দিকে আমার পিতাকে সিও’র হেড অফিসে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় এবং পরে আমার পিতার নামে ২৯ লাখ টাকার মামলা করেন সিও সামছুল।

জানাগেছে, প্রতিমাসে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে সিও এনজিও। নতুন কর্মী যোগ দিলে তার বেতন দেওয়া লাগে কম এবং যোগদানের আগে নতুন কর্মীকে কয়েক দফায় প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেই প্রশিক্ষণ নিতেও সিও’র ফান্ডে জমা দিতে হয় টাকা। সব মিলিয়ে নুতন নিয়োগ মানেই আরেকটি রমরমা ব্যবসা। অভিযোগ উঠেছে সিও’র নির্বাহী পরিচালক বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রেখে চলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোন লাভ হয়না। এ বিষয়ে সোমবার বিকালে সিও এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক সামছুল আলমের বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ঢাকার মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

ঝিনাইদহ শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা আফাজ উদ্দীন জানান, কোন এনজিও ব্লাঙ্ক চেক নিয়ে ঋন বা চাকরী প্রদানের এখতিয়ার রাখে না, এটা সম্পুর্ন অবৈধ। কেউ যদি এটা করে তবে তার বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ম বা আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম জানান, আইন শৃঙ্খলা সভায় সিও সহ বিভিন্ন এনজিও’র অসঙ্গতি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, সরাসরি সিও এনজিওকে নিয়ে তথ্যসহ কোন অভিযোগ পেলে সেটি তদন্ত করা হবে এবং প্রমান মিললে বিধি ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।