বুলবুল খান, গাজীপুর প্রতিনিধি : আজ গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। এই নির্বাচনে এবারই প্রথম ইভিএমে ভোট দেবেন নগরবাসী। আজ এই সিটিতে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন ৩৩২ জন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী। উৎসবের আমেজের পাশাপাশি ভোটকে কেন্দ্র করে নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে নানান শঙ্কা, উৎকণ্ঠা ও জল্পনা-কল্পনা, কে হচ্ছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় মেয়র।

দেশের বৃহত্তম এই সিটি করপোরেশনে গত মঙ্গলবার মধ্য রাতে শেষ হয়েছে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা। কে হচ্ছেন এই নগরের পিতা- এখন তা নিয়ে চলছে ভোটারদের মধ্যে আলোচনা। প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরাও কষছেন ভোটের হিসাব-নিকাশ। তবে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান ও আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হওয়া সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে গাজীপুরের সব কেন্ত্রে পৌঁছে গেছে ইভিএম মেশিনসহ নির্বাচনি সরঞ্জাম। কেন্দ্রে থাকছে সিসি ক্যামেরা। যা নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে মনিটরিং করা হবে জানিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শেষ করেছে সবশেষ প্রস্তুতি। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণের জন্য প্রস্তুত গাজীপুর। আজমত নাকি জায়েদা, আজ রাতেই জানা যাবে কে হাসলেন শেষ হাসিটা।

রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুর সিটির নির্বাচন শুরু থেকেই ব্যাপক আলোচনায়। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও তার মায়ের প্রার্থী হওয়া, জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে বাদ হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে মাকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের ভোটের মাঠে থাকা নিয়ে আলোচনা গাজীপুর ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।

দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় কোনো কমতি রাখেনি নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আওয়ামী লীগের আলোচিত- সমালোচিত দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বাড়িয়েছেন নির্বাচনের উত্তেজনার পারদ। নিজে নির্বাচনে অংশ নিতে না পেরে তার মা জায়েদা খাতুনকে করে তুলেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যডভোকেট আজমত উল্লা খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা বারবার তুলেছেন হামলা ও প্রচার প্রচারে বাধা দেয়ার অভিযোগ। এখন অপেক্ষা ভোটের।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন ৮ জন, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৪৬ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৭৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে একজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ২৫মে নির্বাচনে লড়বেন ৩৩৩ জন প্রার্থী। ৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯২হাজার ৭৪৭জন, মহিলা ভোটার ৫লাখ ৮৬হাজার ৬৯৮জন ও হিজড়া ভোটার আছে ১৮জন। ৪৮০টি ভোট কেন্দ্রে এ ভোট গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যেই ১০ হাজার ৯৭১ জন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। আজ সকাল থেকেই প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনি মালামাল পাঠানো শুরু হবে।

নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র ও আশপাশে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায়ের স্বার্থে র‌্যাব পুলিশের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বিজিবি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ৪৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ৩৫১টি কেন্দ্র (দুই-তৃতীয়াংশের বেশি), আর ১২৯টিকে সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন ৭৬ জন, সঙ্গে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটও থাকবেন। র‌্যাবের ৩০টি টিম থাকবে। বিজিবির থাকবে ২০টি প্লাটুনে প্রতিটিতে ২০ জনের বেশি সদস্য থাকবেন। এ ছাড়া স্ট্রাইকিং ফোর্স পুলিশের ১৯টি ও মোবাইল টিম হিসেবে ৫৭টি টিম থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য ১৭ ও সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ জন সদস্য থাকবেন।

নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, সাধারণ ভোটকেন্দ্রে একজন অস্ত্রসহ এসআই/এএসআই একজন, তিনজন কনস্টেবল, অস্ত্রসহ একজন আনসার (পিসি), অস্ত্রসহ ১জন (এপিসি), ১০ জন আনসার সদস্য সহ মোট ১৬ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী লোক নিয়োগ থাকবে। পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ান আনসার এর সমন্বয়ে প্রতি সাধারণ ওয়ার্ডে ১টি করে মোবাইল ফোর্স, ৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স, প্রতি থানায় একটি করে রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োজিত থাকবে। প্রতি ২ ওয়ার্ডে একটি করে র‌্যাবের টিম ও ৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে এক প্লাটুন করে বিজিবি নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও কেন্দ্র অনুযায়ী থাকবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমাণ আদালত টিম।

মেয়র পদে যারা লড়ছেন

নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খান, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ এরশাদ, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম।

স্বতন্ত্র মেয়র পদে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন (সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা), ঘোড়া প্রতীকে মো. হারুন-অর-রশীদ এবং হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এ নির্বাচনে মেয়র পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে। প্রথমে নির্বাচন সহজ মনে হলেও শেষমেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারেন। দলীয় কোন্দল ও বিবাদে অনেকটা আওয়ামী লীগে ঘরের শত্রু বিভীষণ পরিস্থিতি নগরজুড়ে। ভোটের নানা পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। মেয়র পদে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও মূল লড়াইয়ে থাকবেন আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন, বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে সরকার শাহনুর ইসলাম রনি। তবে ইসলামী আন্দোলনও উল্লেখযোগ্য একটি ভোট পেয়ে আলোচনায় আসতে পারে।

মেয়র প্রার্থীরা কে কোথায় ভোট দেবেন

মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে মো. আজমত উল্লা খান বাড়ির পাশে টঙ্গী দারুস সালাম মাদ্রাসা, জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন ৫৪ নং ওয়ার্ডের টঙ্গী কলেজ রোড এলাকার নিউ ব্লুন হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দেবেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান টঙ্গীর ৫৭ নং ওয়ার্ডের সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজ, জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ এরশাদ নগরের চাংকির টেক এলাকার হাজী আলমাছ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম নলজানির বাড়িআলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেবেন।

এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে জায়েদা খাতুন নগরীর কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সরকার শাহনূর ইসলাম রনি টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতালে, মো. হারুন-অর-রশীদ উত্তর খাইলকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে বিশেষ নিরাপত্তা: জিএমপি কমিশনার

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের শহীদ বরকত স্টেডিয়ামে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ব্রিফিং অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে যেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারি, সেটা নিশ্চিত করব। ভোটকেন্দ্রের আশপাশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল ফোর্স, স্ট্রাইকিং ফোর্স, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। এটা একটা সমন্বিত প্রয়াস। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করব।’

কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বুধবার পর্যন্ত সুন্দরভাবে চলে আসছি। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) নির্বাচনের দিন আপানারা যাতে সুন্দরভাবে দেশবাসীকে খবর জানাতে পারেন সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করব। সিটি নির্বাচনে ৪৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ৩৫১টি কেন্দ্রে আমরা আলাদাভাবে গুরুত্ব দেব। বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে জিএমপি কমিশনার বলেন, ‘প্রিজাইডিং অফিসারের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে। যে কোনো বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসার যোগাযোগ করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। ভোট কেন্দ্র সঠিকভাবে আছে কিনা, নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি আছে কিনা, কোথায় নিরাপত্তার ঝুঁকি, এসব বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা যাতে নির্বাচনটা সঠিকভাবে করতে পারি।’