নিজস্ব প্রতিবেদক : ঘনঘন লোডশেডিং আর গ্যাস সংকটের ফলে ধস নেমেছে গাজীপুরের বিভিন্ন কলকারখানায় উৎপাদনে। শিল্পকারখানা অধ্যুষিত গাজীপুরে লোডশেডিং কম হওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। শিডিউল মেনে ও আগাম তথ্য দিয়ে লোডশেডিংয়ের সরকারি ঘোষণাও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ শিল্প মালিকদের। বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন একেবোরেই কমে এসেছে। ‘একপ্রকার’ লোকসান দিয়েই কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন বলে জানান শিল্প মালিকরা। ফলে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা।

গাজীপুরে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাস সংকট। দীর্ঘদিন ধরেই কোনাবাড়ি, কালিয়াকৈর, ভোগড়া, কাশিমপুর, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে লেগেই আছে গ্যাসের সংকট। বিষয়টি বারবার তিতাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও সংকট নিরসনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি তিতাস।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের ফলে ক্রেতাদের অর্ডার সময় মতো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে ঠিকমতো পোশাক সরবরাহ করতে না পারলে শ্রমিকদেরও বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না। উৎপাদন ধসের জন্য বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সংকটকেও দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। কারখানার বয়লার চালাতে ১৫ পিএসআই প্রেসার দরকার হলেও অনেক সময় তা নেমে দাঁড়ায় এক বা দুই পিএসআইয়ে। এসময় কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানায়, জেলায় থাকা প্রায় দুই হাজারের মতো শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাকের ফলে শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিকে বিদ্যুৎ সংকট থেকেই যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। চলতি বছরের ১৮ জুলাই থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং পদ্ধতি চালু হলেও গাজীপুরে লোডশেডিং চলছে আগের নিয়মেই। যখন ইচ্ছে বিদ্যুৎ যায় আর আসে। সারাদিন দফায় দফায় লোডশেডিংয়ের কারণে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৬৫০ মেগাওয়াট থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে দফায় দফায়।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জিএম যুবরাজ চন্দ্র পাল গণমাধ্যমকে জানান, ১৫৫টি ফিডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো হয়। যার মধ্যে ১০০টি ফিডারে শিল্প কারখানা আর বাকি ৫৫টি আবাসিক। শিল্প কারখানায় লোডশেডিং না করতে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে তা পুরোপুরি মানা সম্ভব হচ্ছে না।

‘জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি লোড ম্যানেজমেন্ট করা হয়’ জানিয়ে তিনি জানান, উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে দ্রুত নতুন নিয়মে লোডশেডিং করা হয়। ফলে গ্রাহক জানতে পারছে না কোন এলাকায় কখন লোডশেডিং হবে।

বিদ্যুতে দফায় দফায় লোডশেডিংয়ের ফলে ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে মারাত্মকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিজেদের বিদ্যুতের ব্যাকআপ থাকলেও ছোট প্রতিষ্ঠানে তা নেই। ফলে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। কয়েকজন কারখানা মালিক জানান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানা মালিকদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়বেন হাজার হাজার শ্রমিক।

উৎপাদন চুক্তি অর্থাৎ প্রোডাকশন রেটে কাজ করা শ্রমিকরা স্বাভাবিকের চেয়ে পারিশ্রমিক কম পাচ্ছেন। গাজীপুর মহানগরীর শিল্প কারখানা অধ্যুষিত ভোগড়া, লক্ষ্মীপুরা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, নাওজোর, বাইপাসসহ আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যেহেতেু উৎপাদন কম হচ্ছে, ফলে তারা পারিশ্রমিকও কম পাচ্ছেন।

তিতাস গ্যাসের গাজীপুরের জয়দেবপুর বিপণন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের শিল্প প্রতিষ্ঠান, ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্র, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক মিলয়ে প্রতিদিন ৬শ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের চাহিদা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ৩শ থেকে ৪শ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে গড়ে প্রতিদিন আড়াইশ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি থেকে যায়। এ ঘাটতি কখনো কখনো আরও বেড়ে যায়। ফলে সরবরাহের ক্ষেত্রে আরও সমস্যা হয়। সার কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্রাধিকারভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করতে হয় বলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে।

তিতাস গ্যাসের জয়দেবপুর শাখার ব্যবস্থাপক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস গণমাধ্যমকে জানান, পর্যাপ্ত গ্যাসের চাপ না থাকায় কলকারখানা থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শীতের শুরুতে প্রতিবছরই জাতীয় গ্রিড লাইনে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। ফলে গাজীপুরে আবাসিক ও শিল্প কারখানায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে।