সারাবিশ্ব ডেস্ক : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চার মাস পর প্রথমবার জনসমক্ষে ভাষণ দিয়ে জুলাই-অগাস্ট মাসে ব্যাপক প্রাণহানীর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দায়ী করেছেন। হাসিনা অভিযোগ করেন, জুলাই মাসে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে ছাত্রদের সকল দাবী মেনে নেয়া সত্ত্বেও আন্দোলন সহিংস করে তোলা হয়, পুলিশ হত্যা এবং বিভিন্ন স্থাপনায় ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে।

তার মতে, লাশের পর লাশ ফেলে সরকারের পতন ঘটানো ছিল একটি নিপুণ নকশার অংশ। আজকে আমার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আসলে গণহত্যা করেছে মুহাম্মদ ইউনূসই, একটা মেটিকিউলাসলি ডিজাইন্ড পরিকল্পনার মাধ্যমে ছাত্র সমন্বয়কদের নিয়ে। তারাই মাস্টারমাইন্ড, শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, যার অডিও ১ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের এক সভায় পরিবেশন করা হয়।

গত ৫ আগাস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে ১ জুলাই শুরু হওয়া বিক্ষোভ তিন সপ্তাহের মধ্যে সরকার পতনের সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়। পুলিশের গুলি এবং অন্যান্য সহিংসতায় অন্তত ৭০০ জন নিহত হন।

শেখ হাসিনা বলেন, তিনি মানুষের মৃত্যু কামনা করেননি, যে কারণে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তিনি অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারীরা গণভবনে হামলা করে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। যেভাবে তারা তৈরি হয়ে আসছিল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে, যেখানে একটা রাষ্ট্র চলমান, একটা সরকার চলমান, সেখানে প্রকাশ্যে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আসা, এটা কোনো ধরনের আন্দোলন? এটা তো সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটাবার চেষ্টা।

যেমন- ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আরেকটা হত্যাকাণ্ড তারা ঘটাতে চায়, হাসিনা বলেন। যখন দেখলাম একটার পর একটা মানুষের জীবন যাচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমার দরকার নেই, আমি চলে যাবো, তিনি বলেন। আগাস্ট মাসের ৬ তারিখের কর্মসূচি তারা ৫ তারিখে নিয়ে আসল এবং তারা গণভবন হামলা করবে। গণভবনে নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেখানে যদি ফায়ারিং হতো, অনেক প্রশ্ন উঠতো, আমি তা চাইনি।

গত ৫ আগস্টের পর থেকে শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছেন, এবং ভারতীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে এই অডিও ভাষণ সেখান থেকেই নিউ ইয়র্কের অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের সম্ভাবনা রয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটআই’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডঃ ইউনূস অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা ভারতে থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, যেটাকে তিনি ‘অবন্ধুত্বসুলভ ইঙ্গিত’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ঢাকা প্রত্যর্পণের অনুরোধ না করা পর্যন্ত উভয় দেশের অস্বস্তি এড়াতে হাসিনাকে নিরব থাকতে হবে।

ক্ষমতা হারানোর চার মাস পর শেখ হাসিনা জনসমক্ষে নীরবতা ভঙ্গ করে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর ব্যাপক হামলা হয়েছে, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ হয়েছে। বিশেষ করে তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের অভিযোগ আনেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান কাওকে বাদ দেয়নি। গির্জা ভেঙেছে, মন্দির ভেঙ্গেছে। হিন্দুরা যখন আন্দোলন করলো, তখন ইসকোনের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছে। সংখ্যালঘুদের উপর এই অত্যাচার কিসের জন্য? কেন তাদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে, হামলা করা হচ্ছে? তিনি প্রশ্ন করেন।

তিনি অভিযোগ করেন, বিচার ব্যবস্থার সব জায়গায় বিএনপি আর জামায়াত বসানো হয়েছে, যার ফলে মানুষ ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। আমার বিরুদ্ধে ২২৯টা হত্যা মামলা, আওয়ামী লীগের সব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ কেউ বাদ যায় নি। সব দোষ আওয়ামী লীগের, কেন? কারণ আওয়ামী লীগ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা এনেছে। আর যারা এসব করছে, তারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ, কিন্তু ভোগ করে সবাই, তিনি বলেন। প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ এই ভাষণের বেশির ভাগ জুড়ে ছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে অর্থনীতিক উন্নতির কথা। হাসিনা তার সমর্থকদের আহ্বান জানান যাতে তারা তাদের সাফল্যের কথা বিশেষ করে যুব সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেয়।

শেখ হাসিনার ভাষণ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বৃহস্পতিবার ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার সব ধরনের ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা আগে যত ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্য দিয়েছেন তা সব মাধ্যম থেকে সরাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।