গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : মহামারি করোনার অভিঘাত শেষ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। চলমান এই যুদ্ধে বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এই সুযোগে ডলার ও বিশ^ব্যাপী খাদ্য সংকটের দোহাই দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা পকেট কাটছে ভোক্তাদের।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা পণ্যের উচ্চ মূল্য সামাল দিতে নানা পদক্ষেপ নিলেও পণ্য বিতরণ ও বিপনন কোম্পানীগুলো জোট বেঁধে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জনগণ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আসন্ন রমজান ও ঈদ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে সাধারণ মানুষ।

কারণ, রমজান মাস এলে প্রতিবছর নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার সুফল তেমনটা আসে না। ফলে এবার রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি অডিটরিয়ামে বাজার সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ভোক্তা অধিকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

গতকাল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও প্রচার) আতিয়া সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে এ তথ্য জানা যায়।

ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পবিত্র রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে অংশীজন ও ঢাকা সিটির অধীন সকল বাজারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের অংশগ্রহণে এটি অনুষ্ঠিত হবে।

বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হবে। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান উপস্থিত থাকবেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গত এক বছরে দেশের বাজারে বাড়তে থাকে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা ডিম, মুরগিসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। পাশাপাশি দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় এবং যাতায়াত খরচও বেড়েছে। এতে আয় ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে শহর ছেড়ে গ্রাম মুখি হয়েছেন অনেকে।

বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চালের দামে দেখা গেছে-গত এক বছরে চিকন চাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৭৫ টাকা, মাঝারি ও মোট চাল ২ টাকা বেড়ে ৫৮ ও ৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দ্বিগুন হয়েছে আটা-ময়দার দাম: খোলা আটার দাম কেজিতে ২৪ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা, প্যাকেট ২২ টাকা বেড়ে ৬৭ টাকা, খোলা ময়দায় ১৭ টাকা বেড়ে ৬৫ টাকা, প্যাকেট ময়দায় ১৫ টাকা বেড়ে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাবে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। সরকারের দাম নির্ধারণের কথা থাকলেও এখন সে কাজ ব্যবসায়ীরা নিজেরাই করে যাচ্ছেন। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ম রক্ষায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েই দায় এড়াচ্ছেন তারা। আর কমানোর বেলায় তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে খোলা সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৭২ টাকায়, গত বছর এই সময়ে ছিল ১৬৭ টাকা, বোতলজাত ১ লিটার ১৮৫ টাকা, গত বছর ছিল ১৬৮ টাকা, ৫ লিটার বোতলজাত ৮৮০ টাকা, গত বছর ছিল ৭৯০ টাকা, খোলা পাম তেল ১২৫ টাকা, গত বছর ছিল ১৪৭ টাকা, সুপার পাম তেল ১৪০ টাকা গত বছর ছিল ১৫৫ টাকা। যদিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ে কারসাজির প্রমাণ পাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর। বাজারে নির্ধারিত দামে তেল বিক্রি না হওয়ায় নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে সংস্থাটি।

চিনি: ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮০ টাকার চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা বা তারও বেশি দামে। বর্তমান বাজারে প্যাকেট চিনি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে খোলা চিনিও উধাও হয়ে যাচ্ছে। ছোলা ও ডাল : নিত্যপণ্যের মধ্যে ডালের বাজারও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি কেজিতে বছরের ব্যবধানে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ভালো মানের খোলা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, গত বছর একই সময়ে ছিল ১২০ টাকা। এ ছাড়া বাজারে ১১০ টাকায় বড় দানার মসুর ডাল পাওয়া যাচ্ছে।

ছোলার বাজারে রোজার আগে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পণ্যটি আমদানিতে কোনো শুল্ক না থাকলেও বছরের ব্যবধানে ১৫ টাকা বেড়ে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হওয়া আলু বর্তমান বাজারে ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত মাসে ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা।

অন্যদিকে গত বছর ৬০ টাকার দেশি রসুন এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়, ১১০ টাকার আমদানি করা রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৯০ টাকা।

ব্রয়লার মুরগি : গত বছর ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা বা ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায়।

গরু ও খাসির মাংস : গরুর মাংসের দাম কেজিতে ১০০ টাকা ভেড়ে ৭৩০ টাকা, খাসির মাংস ২০০ টাকা বেড়ে ১১শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিম : থেমে থেমে অস্থির হয়ে ওঠে ফার্মের ডিমের বাজারও। বর্তমানে ৫০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ও এ বছরের শুরুতে ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

গুঁড়া দুধ : ৬৯০ টাকার গুঁড়া দুধের কেজি বছরের ব্যবধানে ৯০০ টাকা, নিউজিল্যান্ডের ৬৮০ টাকার ডিপ্লোমার কেজি ৮৫০ টাকা, ৫৯০ টাকার ফ্রেশের কেজি ৮৪০ টাকা, ৬২০ টাকার মার্কসের কেজি ৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

হাতিরপুল বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকুরীজীবি মোস্তফা কামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই রুমের ছোট ফ্ল্যাটে থাকতাম। কিন্তু বাজারে সব ধরণের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আয় ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারিনা। খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। যে বেতন পাই তা দিয়ে বাসাভাড়া দিয়ে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ম্যাসে বাসায় থাকি।

রিকশাচালক ছগির মিয়া জানান, গ্রামে মুদির সঙ্গে চায়ের দোকান ছিল তার। করোনার লকডাউনে বন্ধ থাকায় ব্যবসা লোকসানে পড়ে। গত বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পাওনা টাকা না পেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে ঢাকায় আসেন। কোনো কাজ না পেয়ে এখন বাধ্য হয়ে রিকশা চালাচ্ছেন। যে কয় টাকা পান, তা দিয়ে নিজের ও পরিবারের খরচ চলে না। আবার মাস শেষ হতেই কিস্তির (এনজিও) টাকা দিতে হয়। দেনার কারণে চাইলে বাড়িতে যেতে পারেন না। ফলে গোপনে রাতে বা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসেন।

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আরমান হোসেন জানান, গত বছর শাখা ম্যানেজারের দেওয়া টার্গেট পূরণ করতে না পারায় নন-পারপোমার (ব্যর্থ কর্মকর্তা) হয়ে গেছেন। যেজন্য এ বছর বেতন বাড়ার কারও সুযোগ নেই। আরও লোকবল কমানোর ঘোষণায় মানসিক চাপে দিন কাটছে। যে কেনো সময় চাকরি চলে গেলে পরিবার নিয়ে কোথায় যাবেন! সে চিন্তাই দিন কাটছে তার। শান্তিনগর কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা রোকসানা বেগম বলেন, বাজারের প্রত্যেকটি পণ্যের দামে আগুন। সব নিত্যপণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। তদারকি সংস্থাগুলোও যেন নিশ্চুপ। সংশ্লিষ্টরা দেখেও যেন টিনের চশমা পরে আছে।

কেন তারা দাম কমাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে না? কেনই বা তারা দর্শকের ভূমিকা পালন করছে? সংসারের যে মাসিক আয় তা দিয়ে পুরো মাসের ব্যয় বহন করতে হয়। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, সঙ্গে খাবারের খরচ তো আছেই। প্রতিদিন খাবার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এতে অন্যান্য ব্যয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই সরকারের এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্ব যখন করোনা থেকে পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে নেমেছিল, তখন ইউক্রেন আগ্রাসন বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। তবে চলমান পরিস্থিতি এখন আর যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সরকারকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় করে যেতে হবে।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে, যা কাম্য নয়। এতে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত অসহায় হয়ে পড়ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধে সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা দরকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সরকারি পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, অধিদফতরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন দুটি টিম বাজার তদারকি করছে। কোনো অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, যে কটি পণ্যের দাম বেড়েছে, তা কেন বেড়েছে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সঙ্গে পণ্যের দাম ভোক্তা সহনীয় করতে কাজ চলমান আছে। সুত্র : ঢাকা টাইমস