অর্থ ও বাণিজ্য | তারিখঃ ডিসেম্বর ১৮, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 132248 বার
এবিএম রাজিব :
# মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কম খাচ্ছে
# ব্যাংকগুলোতে লুটপাট চলছে
# আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বেশি
# গত ১০ থেকে ১২ বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে-পরিকল্পনামন্ত্রী
রাজধানী ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের পেছনে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। আর খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ছোট করলে ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। কিন্তু নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে আয় তা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনে টিকে থাকা কঠিন। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এখন কম খাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দামও বেশি।
শনিবার সকালে ‘সংকটে অর্থনীতি, কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সংলাপে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নতি এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য কমলেও এতে সরকার পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সরকার এসব ক্ষেত্রে আরও বেশি কাজ করতে চায় উল্লেখ করে এ জন্য সিপিডিসহ সব গবেষণা সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে সংকটে দৃশ্যমানভাবে পাওয়া যায় না, এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল, বাই অর্ডার, বাই অবলিগেশন চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। তার থেকে এসব নেমে আসে। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই আমরা অর্থনীতি চালাচ্ছি। জেনেশুনেই চালাচ্ছি। আমাদের কিছু পণ্ডিত (এক্সপার্ট) আছেন কাজ করেন। তাদের আমরা বিশ্বাস করি।’
গত ১০ থেকে ১২ বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে দাবি করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি একটা গ্রামীণ হাওর এলাকার প্রতিনিধিত্ব করি। প্রতি সপ্তাহে হাওরে যাই, সেখানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলি। হাটবাজারে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলি। বর্তমান সরকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। আগে যেভাবে চালের হিসাব করতে দেখেছি, এখন তা নেই। যে গ্রামে আমি কাদাপানি ভেঙে, সাঁতরে স্কুলে গেছি, এখন বাচ্চারা মোটরসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইটিং বেশি দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। গত চার মাস একটানা মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে অত্যন্ত নিম্নহারে। আশানুরূপ হারে কমছে না। আমাদের ফ্যাক্ট, ফিগার ও তথ্য ও বিসিএস সেটাই বলে। তবে যদি কেউ বলেন এটা সঠিক নয়, আমি তার সঙ্গে আমি বিবাদে যাবো না। এটাকে আমি প্রয়োজন মনে করি না। আমরা সংখ্যা নিয়ে অসত্য কথা বলি না। আমাদের প্রবৃদ্ধির ফিগার এডিবি, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ স্বীকার করেছে।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের বিদ্যমান ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। একটা গোষ্ঠী ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলো গিলে খাচ্ছে। করোনাভাইরাস বা ইউরোপে যুদ্ধের কারণে ব্যাংক খাতে এ সংকট দেখা দিয়েছে, এমনটি নয়। এ খাতের দুর্বলতা দীর্ঘদিনের। মূলত ব্যাংকগুলোতে লুটপাট চলছে। ব্রিটিশরাও এত টাকা লুটপাট করেনি, যত টাকা বর্তমানে ব্যাংকগুলো থেকে লুট হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মহামারি করোনাভাইরাস কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে নয়। এ খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতার মুখোমুখি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। মূলত দুর্বল সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এ খাত ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এটার যদি উন্নতি না হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। এ নাম্বার সবার মুখস্ত।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাস্তবে যেটা দেখানো হয়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি। এটা অর্থনীতিবিদরা ও আইএমএফ বলছে। এর ভেতরে যদি আরও বেশ কিছু আনা হয়, ঋণের পরিমাণটা বাড়বে। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট, লোন যেগুলো রয়েছে, কোর্ট ইনজাকশনের মধ্যে এগুলো হিসাব দেওয়া হলে সেটা দ্বিগুণের বেশি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক, আইন ও তথ্যগত দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে।’
সিপিডির মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ।
সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। এটাকে রেগুলার ডায়েট বলছে সিপিডি। এখানে ১৯টি খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্যতালিকা। বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা রেগুলার ডায়েটের ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই।
সিপিডি বলছে, মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত স্থিতিশীলতার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবুজ উদ্যোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
আরও বলা হয়, ব্যাংক খাত দুর্বল এখনও, সংস্কার পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনও আছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতির অব্যাহত চাপ, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, দেশীয় মুদ্রামানের পতন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে আসা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহে পতন ইত্যাদি।এই সংকট মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে লক্ষ্য নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করে সিপিডি।
সংলাপে সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি নীতিহীন অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। আমরা সংসদে ভুলগুলো উত্থাপন করলে, তা উত্থাপন পর্যন্তই থাকে। বর্তমানে যেভাবে ব্যাংকে লুট চলছে, বৃটিশরাও এভাবে এ দেশ লুট করেনি। চাটার দল আস্তে আস্তে ব্যাংক গিলে খাচ্ছে। ২৫ বিলিয়ন রিজার্ভ নিয়ে এত শঙ্কা কেন সরকারের। এছাড়া যে মেগা প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে তা থেকে মেগা ইনকাম আসছে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ডিনার করে ফুর্তি করা না। প্রচুর মানুষ কীভাবে বিদেশে বাড়ি বানিয়েছে, তাদেরকে চিহ্নিত করুন। আমরা দেশে দক্ষ লোক না বানিয়ে অদক্ষ ভিখারি বানিয়ে ফেলেছি। আর এ অর্থনীতির সংকটে আমরা অর্থমন্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না। তিনি পদ্মফুলের মতো বছরে একবার ফোটেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতির মূল সংকটের একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা। তারা বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। অথচ ভারতের মতো রাষ্ট্রে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়। এটা তো বাজেট না যে, বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাতে মূলত স্বচ্ছতার অভাব। ডাটা পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। কয়েকবছর আগে ব্যাংক খাত সংস্কার করা হলো। কিন্তু দেখা গেলো এটা উল্টোরথে গেলো। তাদের জিজ্ঞেস করেন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট কীভাবে বাড়লো? তারা কোথায় এ বিনিয়োগ বাড়ালো?’
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবিব মনসুর বলেন, ‘ঝড়ের আগে পরিবেশ খুব ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু যখন প্রলয় এসে যায়, করার কিছুই থাকে না। দেশের অর্থনীতিরও একই অবস্থা। ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ক্রমান্বয়ে কমছে। কিন্তু ভারতের মতো রাষ্ট্রে তা ১৯-২০ শতাংশ। তাদের ক্যাপাসিটি টু অ্যাবজর্ব আর আমাদের ক্যাপাসিটি টু অ্যাবজর্ব কি এক হলো?’
তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, জানুয়ারির মধ্যে ডলার সংকট কেটে যাবে। আমি বলি, আগামী ছয়মাসেও ডলার সংকট কাটবে না। আরও বেশি সময় লাগতে পারে। ব্যাংকে সংকট এত প্রকট যে, অল্প কয়েকদিনে পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, এটা তো তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। রিজার্ভের হিসাবে কোনো আন্তর্জাতিক নিয়ম নেই। রেগুলটরি সংস্থা কিছুই করবো- টাইপের ভাব নিয়ে বসে আছে। তবে সরকারকে ধন্যবাদ আইএমএফের সঙ্গে খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সংকটে মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে দেখলে হবে না। দুটোকে আলাদা করে দেখুন। দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে দুটো কারণে। প্রথম কারণ হলো- আন্তর্জাতিক। আরেকটি অভ্যন্তরীণ বাজারের অনিয়ম।’
তিনি বলেন, ‘সাপ্লাই বাড়লে দেশের মূল্যস্ফীতি কমতে সাহায্য করবে। মিনিমাম ওয়েজ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সমাধান সম্ভব না। আইএমএফের কাছ থেকে সঠিক পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত কি জানি না। পরামর্শগুলো সবাই জানি। কারণ তাদের পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে আইএমএফ অর্থ ছাড় করে না।’
সংলাপে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘সাবসিডি (ভর্তুকি) যদি দিতেই হয়, তাহলে পুঁজিবাজারে দেন। গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিলো! ফলে তার দাম এত কমে গেছে যে, বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। আর বিএসইসির ফ্লোর প্রাইস দিয়ে তো শেয়ারবাজার চালানো যায় না।’