আইন ও আদালত | তারিখঃ এপ্রিল ১২, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 1973 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক : দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাত করে সার্ভার থেকে যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগে ডেল্টা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। মামলাটি আইসিটিতে হওয়ায় তদন্তের প্রয়োজনে থানা পুলিশ সিআইডি বা সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহায়তা নেবে। গত ৫ এপ্রিল ডিএমপির গুলশান থানায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ—আইডিআরএর অফিস সহকারী এমদাদুল হকের করা ওই মামলায় মনজুরুর ছাড়াও ডেল্টা লাইফের আরও সাত কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন হলেন মনজুরুরের মেয়ে ডেল্টা লাইফের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান ও ছেলে সাবেক বোর্ড পরিচালক জিয়াদ রহমান।
অন্য আসামিরা হলেন ডেল্টা লাইফের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইটি ইনচার্জ কাজী এহতেশাম ফয়সাল, সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মো. মহসিন রেজা, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সাময়িক বরখাস্ত) মিল্টন বেপারী, জয়েন্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট পল্লব ভৌমিক এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আসাদুজ্জামান মল্লিক।
বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ বলছে, ডেল্টা লাইফের দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতে কোম্পানিটির সাবেক চেয়াম্যান মনজুরুর রহমানসহ মামলার আসামিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। আসামিরা পরষ্পরের যোগসাজশে অর্থ সাত্মসাতের পর ডাটাবেইজ থেকে সব তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলেছে।
আইডিআরএর তদন্তে উঠে এসেছে, ডেল্টা লাইফের অডিট কার্যক্রম ব্যহত করা এবং অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতি আড়াল করার উদ্দেশেই আসামিরা পরিকল্পিতভাবে এসব তথ্য-উপাত্ত মুছেছেন। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলাটি করা হয়েছে।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালিউর রহমান। তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘তদন্তভার পেয়েই কাজ শুরু করেছি। এই কদিনে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে।’
আইসিটি মামলা হওয়ায় তদন্তের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সক্ষমতা থানা পুলিশের আছে কি-না প্রশ্নের উত্তরে এসআই ওয়ালিউর বলেন, ‘থানা পুলিশের সক্ষমতা থাক বা না থাক বাংলাদেশ পুলিশের আছে। তদন্তের প্রয়োজনে সিআইডি অথবা সাইবার ক্রাইমের সহযোগিতা নেবো।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক বিষয় গুরুত্বে রেখেই তদন্তকাজ করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে আসামিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মনজুরুরসহ আসামিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চলমান নিরীক্ষা কার্যক্রম ব্যহত করার এবং অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতি আড়াল করতে কোম্পানির ভিপি এবং আইটি ইনচার্জ কাজী এহতেশাম ফয়সাল এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মো. মহসিন রেজা ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলেন।
মনজুরুর রহমানসহ বাকি আসামিদের নির্দেশে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তারা এমন অপরাধ সংঘটিত করেন। পাশাপাশি কোম্পানির প্রশাসক এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আইটি বিভাগের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর, হ্যাকিং এবং কম্পিউটার সিস্টেমে অবৈধ নজরদারি করেন। এমনকি প্রয়োজনমতো তথ্য বিন্যাস, বাতিল ও পরিবর্তন করেছেন।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর নির্দেশে পরিচালিত অডিটে ২৫টি এবং ২২টি অডিট আপত্তি প্রকাশিত হয়।
পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিমা পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষ কোম্পানি পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করেন। বর্তমানে আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ও একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মাধ্যমে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের নিরীক্ষা কার্যক্রম চলছে।
এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২৭ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানির ভিপি এবং আইটি ইনচার্জ কাজী এহতেশাম ফয়সাল, এভিপি শেখ মো. মহসিন রেজার কাছে গণ-গ্রামীণ বীমা বিভাগের ডাটাবেজের তথ্য চেয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু সে সময় মনজুরুর রহমানসহ অন্য আসামিদের নির্দেশ ও সহায়তায় তথ্য প্রদান না করে নিরীক্ষা কার্যক্রম ব্যহতের উদ্দেশে তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলার পাশাপাশি পরিবর্তনও করেছে।
ডাটাবেজ থেকে তথ্য মুছে ফেলার মৌখিক অভিযোগ পেয়ে গত ৪ নভেম্বর ডেল্টা লাইফের কার্যালয় পরিদর্শনে যায় আইডিআরএ। পরিদর্শন শেষে সংস্থাটি জানায়, এই সময় তারা শেখ মো. মহসিন রেজার কম্পিউটার থেকে ডাটা মুছে ফেলা এবং পরিবর্তনের প্রাথমিক আলামত পায়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলা এবং পরিবর্তনের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে পেশাদার অডিট ফার্ম একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গত ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী রিপোর্টে ডাটাবেইজ থেকে তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলার মাধ্যমে কোম্পানির কম্পিউটার সিস্টেমের ডাটাবেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সত্যতা পায়। পরবর্তী সময়ে গত ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত একনাবিনের রিপোর্টের ১৩৪ থেকে ১৪৮ পৃষ্ঠায় অর্থাৎ ১৫টি পৃষ্ঠায় ২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে তথ্য মুছে ফেলা ও পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেসময় অডিট ট্রেইল লগ চালু না থাকার কারণে কোনো কোনো তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
আইডিআরএ বলছে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর অডিট প্রতিষ্ঠানটি তাদেরক জানায়, ডেল্টা লাইফের অডিট ট্রেইল লগটি চালু ছিল না। ডাটা মুছে ফেলার বিষয়ে অভিযোগের পর আইটি বিভাগের ভিপি কাজী এহতেশাম ফয়সাল গত ১১ নভেম্বর তার স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে জানান, তারা অডিট ট্রেইল লগটি চালু করেছেন। অর্থাৎ আগে থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্নীতি এবং অনিয়ম গোপন করার উদ্দেশে ডাটাবেজ থেকে তথ্য মুছে ফেলতে ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রেইল লগটি বন্ধ করা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন সংশ্লিষ্টরা।
শেখ মো. মহসিন রেজা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বীকার করেছেন, কালেকশন টেবিল আপডেট হচ্ছিল। মানি রিসিট ও প্রিমিয়াম রিসিট এন্ট্রি করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেম সফটওয়্যার কালেকশন টেবিলটি আপডেট করে নেয়। অডিট কার্যক্রম ব্যহত করার উদ্দেশেই অন্যায়ভাবে মানি রিসিট ও প্রিমিয়াম রিসিট পরিবর্তন করা হয়েছিল। ফলে কালেকশন টেবিল আপডেট হয়েছিল। তথ্য মুছে ফেলার বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য এভিপি জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া এবং ইও নুর আলমের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির গত ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত রিপোর্টেও তথ্য মুছে ফেলার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়।
এদিকে মনজুরুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিং, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান।