নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের আর্থিক খাতের আলোচিত লুটেরা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার, যার বিরুদ্ধে থাকা ৫১টি মামলার মধ্যে একটিতে ২২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অন্যগুলোর রায় হয়নি।

বর্তমানে ভারতের কারাগারে বন্দি এই পিকে হালদারের তিন বান্ধবী আলোচনায় থাকলেও তার দুর্নীতি তদন্তে নেমে দেশে ৮০ জন বান্ধবীর সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ভারতেও পিকের সঙ্গে সেখানে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক বান্ধবী।

পিকের শতাধিক বান্ধবী থাকলেও এখন পর্যন্ত ৮১ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। যাদের পেছনে হাজার কোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি। এদের মধ্যে নাহিদা রুনাই, অবন্তিকা বড়াল ও শুভ্রা রানী ঘোষের পেছনেই ৭০০ কোটি টাকা খরচের প্রমাণ মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে।

তাহলে এত বান্ধবী দিয়ে কী করতেন পিকে হালদার? কী কাজে লাগাতেন বান্ধবীদের? আর বান্ধবীরাই বা কেন পিকে হালদারকে একান্তে পেতে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে যেতেন দিনরাত?

এসব প্রশ্নের উত্তরও মিলেছে তদন্তে। উঠে এসেছে- পিকে হালদারকে ঘিরে তার বান্ধবীদের কাড়াকাড়ির চিত্র। পিকে হালদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেই কি বান্ধবীরা তাকে একান্তে পেতে চাইতেন, নাকি ভালোবাসতেন পিকে হালদারকে?

তদন্তকারীরা বলছেন, পিকে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকায় চোখ ছিল বান্ধবীদের। তবে ওই বান্ধবীদের ব্যবহার করেও কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন পিকে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালে প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার বিনোদনের ছায়াসঙ্গী ছিলেন দুই বান্ধবী, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর জন্য আলাদাভাবে দুজনকে নিয়ে পিকে হালদার শুধু সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন ২৫ বার। এছাড়াও দেশ-বিদেশে কতবার আনন্দ ভ্রমণ করেছেন, সে হিসাব মেলানো দুষ্কর। কেবল আনন্দ-বিনোদন দিয়েই দুই বান্ধবী শত কোটি টাকার মালিক।

পিকে হালদারের বান্ধবী রসায়ন উঠে এসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া তার সহযোগী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও।

দুদক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেয়া জবানবন্দি থেকে পিকে হালদারের সঙ্গে দুই বান্ধবীর বেপরোয়া প্রেম-ভালবাসা, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানো, আনন্দ বিনোদন ভ্রমণ কাহিনীর বর্ণনা জানা গেছে। অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল অর্থ বিত্ত বৈভবের মালিক পিকে হালদারকে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ করে রাখতেন অবন্তিকা ও রুনাই। পিকে হালদারকে একান্তে নিজ বাহুডোরে বেঁধে রাখার জন্য দুই বান্ধবীর মধ্যে লড়াই চলত সমানে সমান।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিকে হালদার দেশ ছাড়ার আগ মুহূর্তে বিদায় বেলায়ও ছায়া হয়ে কাছে ছিলেন অবন্তিকা ও রুনাই। দুজনই লম্বা, ফর্সা, আকর্ষণীয় চেহারার তরুণী। দুই বান্ধবীই পাশাপাশি বসে বিদায় জানিয়েছেন পিকে হালদারকে। কথা বলতে বলতে অবন্তিকার হাতের ছোঁয়া লাগছিল পিকের হাতে। তবে বিদায় বেলায় পিকে হালদারের মুখ বিষন্ন। তা কাটাতে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন অবন্তিকা। অবন্তিকা পিকের কানের কাছে মুখ নিয়ে মিষ্টি করে কিছু একটা বলেন ।

অবন্তিকার হাত শক্ত করে ধরে আছেন পিকে হালদার। এমন সময় হঠাৎ তারা দুজনেই চমকে উঠলেন। তাদের সামনে আচমকা উপস্থিত রুনাই। হালদারের সঙ্গে থাকা অবন্তিকার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকান রুনাই। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। তারপর রুনাই ও অবন্তিকাকে নিয়ে পিকে হালদার চলে গেলেন বাসায়। সেখানে পিকে হালদারের সামনেই তুমুল ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন অবন্তিকা ও রুনাই। এমনকি অবন্তিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পিকে হালদারের গায়ে হাত তোলেন রুনাই।

অর্থ বিত্ত বৈভবের মালিক পিকে হালদারকে কাছে পেতে মরিয়া ছিলেন দুই বান্ধবী। নিজেদের রূপ, যৌবন দিয়ে কাছে টেনে রাখতে চাইতেন। এ নিয়ে অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইয়ের মধ্যে এক ধরনের যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু দুই বান্ধবীকেই একান্তে চাইতেন পিকে হালদার। একজনের অজান্তে অন্যজনকে নিয়ে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতেন। চলে যেতেন দেশের বাইরে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদার দেশে থাকার সময় এক দিন বসা ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে। ব্যাংকের ভেতরেই পিকে হালদারের সঙ্গে ঝগড়া করেন নাহিদা রুনাই। এমনকি রুনাই রাতের বেলায় পিকে হালদারের বাসায় গিয়ে তার রুমে ভাংচুর চালান। একদমই সহ্য করতে পারতেন না অবন্তিকাকে। দুই বান্ধবীকে এক সঙ্গে সামাল দিতে মাঝেমধ্যেই মহাসংকটে পড়ে যেতেন পিকে হালদার।

ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে যেতেন পিকে হালদার। কখনও তারকা হোটেলের কক্ষে ভাসতেন সুখের মোহনায়। স্বল্প পোশাকে বান্ধবী নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাওয়া, গোসল করা, বারে ড্যান্স করা ছিল তার শখ।

বাংলাদেশ থেকে পালানোর পর ২০২২ সালের ১৪ মে পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। তিনি ভারতের কারাগারে রয়েছেন।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দেশে যে ৫২টি মামলা রয়েছে, এর মধ্যে ১২টির আসামী রুনাই। তিনি কাশিমপুর কারাগারে। আলোচিত আরেক বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল আছেন মুন্সীগঞ্জ কারাগারে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পিকে হালদার ব্যাংক খাত থেকে টাকা হাতানো বা পাচারে বাধা হয়ে না দাঁড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ওপর মহলকে ম্যানেজ করতেন বান্ধবীরা। প্রয়োজনে ওই কর্মকর্তাদের নিয়ে দেশের নামিদামি ক্লাব-রিসোর্টে বা দেশের বাইরে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে প্রমোদ ভ্রমণেও পাঠানো হতো। এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে বান্ধবীদের শূন্য থেকে পলকে কোটিপতি বানিয়েছেন পিকে হালদার।

পিকে হালদার সিন্ডিকেটের দুর্নীতির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পিকে হালদারের দুর্নীতি প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় রবিবার একটি মামলায় আদালত তার ২২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। সেগুলোর রায়েও পিকে হালদার কঠোর সাজা পাবেন বলে আশা করছি।’