নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : গত বছর চট্টগ্রামের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় কারও দায় খুঁজে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে গত বুধবার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। যদিও ওই ঘটনার পর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বলেছিল, মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।

‘কারও দায় না থাকলে ৫০ জন মানুষের মৃত্যু কেন’ পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর উঠেছে এ প্রশ্ন।

চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, ‘কারও দায় না পাওয়ায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ গত বুধবার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আদালত যদি সেটিসফাইয়েড (সন্তুষ্ট) না হয়, তাহলে নারাজি দিতে পারবে, অন্য কোনো সংস্থাকে পুনঃতদন্ত করতে দিতে পারে।’

পুলিশের দেওয়া এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালত গ্রহণ করবে কি না, সে বিষয়ে আগামী সোমবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, আমাদের তদন্তে আমরা দেখেছি এটা ‘মিসেটক অব ফ্যাক্ট’। ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটার সাথে যারা আসামি, তারা কেউ সংশ্লিষ্ট না। এটা একটা নিছক বিস্ফোরণ।

গত বছর ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর একের পর এক বিস্ফোরণে তা ছড়িয়ে পড়ে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন ৮৬ ঘণ্টা পর বিভিন্ন বাহিনীর চেষ্টায় নেভানো হয়।

ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকা-ের এক মাস পরও সেখান থেকে পোড়া হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।

বিস্ফোরণের তিন দিন পর ৭ জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানায় দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় একটি মামলা করেন এসআই আশরাফ সিদ্দিকী।

ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আকতার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) আবদুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, একই বিভাগের নজরুল ইসলাম ও জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খানকে সেখানে আসামি করা হয়।

সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ প্রথমে মামলাটি তদন্ত করলেও পরে তদন্তভার পায় চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

এর মধ্যে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি গতবছর ৬ জুলাই প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি ওই কনটেইনারে অগ্নিকা-ের ঘটনায় মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না।

অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন সংস্থার পরিদর্শনে ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার বিষয়টি উঠে আসে। বিএম ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স থেকে এসব রাসায়নিক বিদেশে রপ্তানির জন্য সেখানে রাখা ছিল।

প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডই ডিপোতে ‘আগুনের উৎস’।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার শফিউল্লাহ বলেন, ‘যাদের আসামি করা হয়েছে তারা আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করেন। আসামিদের মধ্যে অনেকেই হতাহত হয়েছেন। যাদের আসামি করা হয়েছে তারাও আগুন নেভানোর চেষ্ঠা করেছেন। তদন্তে আমাদের কাজটা ছিল কোনো ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হয়েছে কিনা, কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কিনা কিংবা কোন ‘ইল মোটিভ’ ছিল কিনা সেটা দেখা।’

পুলিশ সুপার বলেন, ‘যার যেটা দেখার দায়িত্ব না, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া আইনে পারমিট করে না। আমাদের তদন্তেও সেটা আসেনি।’

বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুই কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এই ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয় ২০১১ সালে। এর মালিকানায় আছেন বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার ছোট ভাই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান।

স্মার্ট গ্রুপের আরেক কোম্পানি আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির জন্য রাখা ছিল কনটেইনার ডিপোতে। ওই রাসায়নিকই যে আগুনকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে, সে কথা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ওই কন্টেইনার ডিপোতে ২০২২ সালের ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা ও সীতাকুণ্ডের দুটি ইউনিটের কর্মীরা তা নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে একের পর এক বিস্ফোরণ শুরু হলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

বিকট বিস্ফোরণের ধাক্কায় বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে, পাশের গ্রামের ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।

ডিপো কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ৪৪০০ এর মত কন্টেইনার ছিল। এর মধ্যে অন্তত ৪০০ কন্টেইনার ধ্বংস হয়েছে বলে সে সময় তথ্য দিয়েছিলেন উদ্ধারকর্মীরা।

অর্ধশত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে, বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে, ৮৬ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় সেই নরককুণ্ড। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে নয়জনই ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।

যেদিন রাতে ওই ডিপোতে আগুন লাগল, পরদিন সেখানে গিয়ে পোড়া ও জ্বলন্ত কনটেইরারের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় নীল রঙের বেশ কিছু জেরিকেন। ফেটে বা গলে যাওয়া সেসব জেরিকেনের গায়ে লেখা ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। তাপ পেলে যে সেগুলো বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে- সে সতর্কবাণীও লেখা ছিল গায়ে।

বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছিল, ওই ডিপোতে মোট ৩৭টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল। প্রতি কন্টেইনারে ছিল ৬৮০টি করে রাসায়নিক ভর্তি জেরিকেন। প্রতি জেরিকেনে ৩০ লিটার করে রাসায়নিক ছিল।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি মোট ২৫টি কন্টেইনার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমিটির সদস্যরা কন্টেইনারগুলোর ভেতরে কাঠের পাটাতন পেয়েছেন। কেমিকেল ভর্তি জেরিকেনগুলোর সনদও যথাযথ ছিল না।

ডিপোতে আগুন লাগার পরদিন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেছিলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন শুরুতে। পানি ছিটাতে শুরু করার পর শুরু হয় বিস্ফোরণ। ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি।

আর বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডিপোটিতে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি ছিল না। শুধু হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণে আগুন লেগে বিস্ফোরণ হয়নি। সেখানে অন্য কোন দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।

রাসায়নিক রাখার বিষয়ে ওই ডিপো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ছাড়পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নেয়নি বলে সংস্থাটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম সে সময় জানান।

যে কারখানায় ওই হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তৈরি হয়েছিল, ইটিপির শর্ত পালন না করায় সেই আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ছাড়পত্রও পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২১ সালের পর আর নবায়ন করেনি।