খুলনা বিভাগ, জেলার খবর, যশোর | তারিখঃ মে ১, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3978 বার
আসাদুজ্জামান আসাদ।। দিনটি শ্রমিকদের জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে ছুটির হলেও অনেকেরই সেই ফুরসত মেলে না; পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে আর দশটি দিনের মতোই কাজে বেরুতে হয়, উপার্জন করতে হয়।
সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও যখন সোমবার সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস উদযাপিত হচ্ছে তখন কাজে বেরিয়েছেন যশোরের শার্শা উপজেলার সামটা গ্রামের আল-আমিন।
এই নির্মাণশ্রমিক জানেন সোমবার মে দিবস। কিন্তু ভোরেই তাকে কাজে বেরোতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “মে দিবস তো জানি। কাজে না গেলে কে খেতে দেবে? কাজ না করলে কি কেউ পয়সা দেবে? কাজ করেই তো খেতে হবে। কাজে না গেলে টাকা মিলবে না; চুলায় হাঁড়ি চড়বে না, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় হবে না।”
সামটার বিলে কাজ করছিলেন জামতলা গ্রামের কৃষক মহিবুল ইসলাম। সঙ্গে তার কয়েকজন সঙ্গী ছিলেন। মে দিবসের কথা বললে তিনি একটু অবাকই হন।
তিনি বলেন, “মে দিবস করলে কেউ টাকা দেবে? পেটে ভাত যাবে কীভাবে? কাজ না করলে পরিবার নিয়ে খামু কী।“
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেটের শ্রমিকরা ১৮৮৬ সালে শ্রমের ন্যায্যমূল্য এবং আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলন দমন করতে সেদিন গুলি চালানো হয়।
সেদিন ১০ শ্রমিকের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠে বিক্ষোভ। প্রবল জনমতের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর শ্রমিকদের সংগ্রামী ঐক্যের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৯০ সাল থেকে সারা বিশ্বে মে মাসের প্রথম দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
১৭ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন টেংরা গ্রামের আশরাফ আলী। মে দিবসেও তার ছুটি নেই। তিনি বলেন, “দুটো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করাচ্ছি। বসে থাকলে চলবে?”
বড়বাড়িয়া গ্রামের ইটভাটা শ্রমিক কবির হোসেন (৫০)। তিনি শ্রমিকদের সর্দার হিসেবে কাজ করেন। কথা হয় তার সঙ্গে।
মে দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই কবির বলেন, “মাঠে কোনো জমাজমি নেই। এই কাজ করে মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। দুটি ছেলের পড়াশোনা করাচ্ছি। বড় ছেলে শামীম রেজা অনার্স শেষ বর্ষে আর ছোট ছেলে তামিম হোসেন দশম শ্রেণিতে পড়চ্ছে।
‘কাজ না করলে পরিবার নিয়া খামু কী’
“গরিব মানুষের আবার মে দিবস! এ সব পালন করতে গেলে সংসারে টান পড়বে।”
পাঁচ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে সেই টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন সামটা গ্রামের শাহাবুদ্দিন। সাতক্ষীরা সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন তিনি।
শাহাবুদ্দিন বলেন, “আজ সরকারি ছুটি থাকায় পুরোদিন কাজের সুযোগ পেয়েছি। গরিব মানুষের আবার মে দিবস!”
শার্শার রিফা ব্রিকস নামের একটি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজটি করেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের তৌহিদুর রহমান। ৪৮ বছর বয়সী তৌহিদ ১২ বছর ধরে এ কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “যে টাকা মুজুরি পাই তা দিয়ে সংসারের খরচ জোড়াতালি দিয়ে চলে। কষ্ট হয়, তারপরেও কাজ করি। আমাদের আর মে দিবস।”
পাশে থাকা শ্রমিক তাসলিমা বেগমের ভাষায়, ইটভাটার কাজ জাহান্নামের আগুনে পোড়ার সমান।
“স্বামী আরেকটা বিয়া করছে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকায়া আগুনে পুইড়াই কাজ করতে অয়।”
‘কাজ না করলে পরিবার নিয়া খামু কী’
মে দিবস কী, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই তাসলিমার। তিনি শুধু জানেন, একদিন কাজ বন্ধ থাকলে খাওয়া জুটবে না।
আম ব্যবসায়ী সাফিরুল ইসলাম (৪৫) একজন দিনমজুর বাবুর আলিকে নিয়ে গাছে স্প্রে করাচ্ছেন।
বাবুর আলি বলেন, “একদিন কাজ করলি ৪০০ টাকা পাই। মে দিবস করলি কী কেউ টাকা দেবে?”
শার্শার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘প্রগতি কনস্ট্রাকশন’ এর শ্রমিকদের তত্ত্বাবধায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, “যে শ্রমিকদের পরিশ্রমের ফলে এই দেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তাদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে।”
কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের টাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হলেও শ্রমিকদের সেই মানবেতর জীবনই যাপন করতে হচ্ছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
মহান মে দিবসের মূল যে অর্জন বা চেতনা সেটি বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ মানুষের কাছে আজও পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে যেসব সংগঠন তারা এমনটাই বলছেন। কারণ হিসেবে তারা কৃষি কাজ, গৃহ শ্রমিক, দিনমজুরদের মত যারা অ-প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজে শ্রম দিচ্ছেন, তারা সব ধরনের শ্রম আইনের বাইরে। তাদের মিলছে না কোন ধরনের অধিকারই।
বাংলাদেশের শ্রম আইন মূলত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি করা। দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক গৃহ শ্রমিকসহ যে ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষ আছে তাদের সুরক্ষার আসলে তেমন মানদন্ড নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের মজুরী বা অন্যান্য পাওনা নির্ভর কর মালিকদের ইচ্ছার ওপর। কোনমতেই দেশের ৮৫ ভাগের মত শ্রমজীবী মানুষকে বঞ্চিত রেখে, আইনের সুরক্ষা থেকে বাইরে রেখে তাদের মজুরির ব্যাপারটি ঠিকাদার ও মালিকদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়ে মে দিবস পালন করা যুক্তিসঙ্গত হবে না।