খুলনা বিভাগ, জেলার খবর, যশোর | তারিখঃ এপ্রিল ২৬, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3979 বার
মোঃ রানা হোসেন : নারী ও শিশু পাচার একটি সামাজিক সমস্যা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশ যদিও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এসেছে; তথাপি নারী ও শিশু পাচার একটি জটিল সামাজিক সমস্যা ও অর্থ উপার্জনের জঘন্য উৎস হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজটি যে কতভাবে সংঘটিত হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বল্পোন্নত দেশের জনগণের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অসাধু মানুষ পাচারের কাজে লিপ্ত হয়। মধ্যযুগে মানুষকে যেভাবে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে পাচারের মাধ্যমে ঠিক তেমনিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারকৃত শিশুদের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। পাচারের কারণে শিশুর সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের সুখ-শান্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষাও শেষ হয়ে যায়।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে। তারপরও এ দেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের সুযোগে একটি চক্র নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজটি করে থাকে। এসব পাচারকারীচক্র নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। পাচারকারীরা পাচারের সময় নানাকৌশল যেমন: অপহরণ, প্রেম-ভালোবাসার ফাঁদ, সাজানো বিয়ে, ভালো চাকরির প্রলোভন, পুনর্বাসনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, প্রতিপালন করার প্রলোভন, আর্থিক সাহায্যের প্রলোভন, ভালো খেলনার প্রলোভন ইত্যাদি অবলম্বন করে থাকে।
গত ১০ বছরে শুধু ভারতেই প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি নারী ও শিশু পাচার হয়েছে, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ৩০ বছর। বাংলাদেশের যত শিশুর ক্ষেত্রে মিসিং বা ট্রাফিকিংয়ের ঘটনা ঘটে, এর মাত্র ২৭ শতাংশ পত্রিকায় ও ১২ শতাংশ টিভি নিউজে দেখা যায়। বিদেশি একটি চক্র দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এক শক্তিশালী পাচার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যারা নারী-শিশুসহ কিডনি পাচারে সক্রিয়। প্রতিবছর ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যায়।
এশিয়ার মধ্যে নারী পাচারের ঘটনার দিক থেকে নেপালের পরেই বাংলাদেশের স্থান। পাচারকারীরা স্থল, পানি বা আকাশপথে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচারের যে ঘটনাগুলো ঘটে, তাতে দেখা যায়, বিমানযোগে কিছু পাচার হয়, তবে স্থলপথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই বেশিসংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এ দেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ২২২ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর সীমানা দিয়েই পাচার হয় বেশি। যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার শাকারা, ভোমরা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কক্সবাজার, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছয়টি রুটসহ অন্তত ১৮টি রুট দিয়ে আশঙ্কাজনকহারে পাচার হচ্ছে নারী ও শিশু।
সম্প্রতি টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, ডিসকড, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে পাচারের জন্য নারীদের সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিজস্ব দালাল নিয়োগ করেও নানা কৌশলে এ দেশ থেকে নারীদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম ৩০টি বা তারও বেশি চক্র সারা দেশে বিস্তৃত রয়েছে। কিছু চক্র নারীদের গৃহপরিচারিকার চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ সেল গঠন করা প্রয়োজন। যেসব দেশে নারী-শিশু পাচার হয় সেসব দেশের সঙ্গে নারীশিশুদের ফিরিয়ে আনা ও চুক্তির ব্যবস্থা করাসহ, আদালতে পাচারকারীদের জামিন অযোগ্য আইন করা, পাঠ্যপুস্তকে পাচারের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা, পাচারকারীর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন।
মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার নিকৃষ্টতম জঘন্য অপরাধ। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই মানব পাচার, বিশেষ করে নারী ও শিশু পাচাররোধে সফলতা বয়ে আনবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সম্পর্কে সম্মানের চর্চা থাকলে নিশ্চয়ই পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধ হবে। মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবোধ জাগ্রত হোক, জয় হোক মানবতার-এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়।