কুষ্টিয়া, খুলনা বিভাগ, জেলার খবর | তারিখঃ ডিসেম্বর ৩১, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 4128 বার
মোড়ল ইলিয়াস হোসেইন : খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগর। একাত্তরে এখানে পাকিস্তানি হানাদাররা চালায় নৃশংস গণহত্যা। সেসময় দুধের শিশু রাজকুমারী সুন্দরী বালা। হানাদারদের হাতে প্রাণ হারায় সুন্দরী বালার মা। মৃত মায়ের বুকেই লেপ্টে ছিল এক বছরের শিশু সুন্দরী।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়েছে। সুন্দরী বালার বয়স এখন ৫২ বছর। এত দীর্ঘ সময়েও তার বুকে মা হারানোর দগদগে ক্ষত। একাত্তরে কিছু বুঝে ওঠার মতো বয়স না হলেও দুঃসহ স্মৃতি এখনো সুন্দরী বালার গাল বেয়ে অঝোর ঝরায় দুচোখের জল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গণহত্যার পথ বেছে নেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয় এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যার সাক্ষী ‘চুকনগর’। গণহত্যার নৃশংসতা আজও প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে বেড়ায় চুকনগরবাসীকে। ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার চুকনগরে ঘটে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, দিনে তিন-চার ঘণ্টার লাগাতার হত্যাযজ্ঞে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। মৃত মায়ের দুধপান করে বেঁচেছিল একটি শিশু।
স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে। তাদের মমতা ও ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে শিশুটি। একাত্তরে চুকনগর গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া সেই শিশুটির কাছে শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটাই বাবা-মায়ের স্মৃতি।
গণহত্যায় প্রথম নিহত হন শহীদ চিকন মোড়ল। তার ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ আলী মোড়ল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২০ মে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গাড়ি আসে। একটা গাড়ি চুকনগর বাজারের দিকে যায়। আর একটা গাড়ি বধ্যভূমির দিকে আসে।’
‘আমি আর আমার আব্বা (চিকন মোড়ল) বধ্যভূমির পাশের একটি জমিতে ঘাস কাটছিলাম। আব্বা বললো মিলিটারির গাড়ি আসছে শিগগির বাড়ির ভেতরে যা। তখন আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যাই।’
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তার বাবার কানে কানে কি যেন বলছিল আর তা শুনে চিকন মোড়ল হাতে থাকা কাস্তে দিয়ে কোপ মারতে যায়। এরশাদ আলী মোড়ল বলেন, ‘তখন তারা আমার আব্বাকে প্রথম গুলি করে। তখন আমরা বধ্যভুমির আশপাশে যত মানুষ ছিলাম তখন সবাই বাড়িছাড়া হয়ে যে যেখানে পারলাম চলে গেলাম।’
বাবাকে আর ফিরে পাবে না বলে এরশাদ আলীকে বলেন মা। যাদের ওপর নৃশংসতা চালানো হয়েছে তাদের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে কি না এরশাদকে খোঁজ নিতে বলেন তার মা।
এরশাদ আলী বলেন, ‘তখন আমি এক পা দুই পা করে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা মৃত মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে একটা শিশু। মেয়ে শিশুটাকে আমি কাঁধে তুলে নিলাম। একদিকে আমার বাপ মারা গেল আর একদিকে এই মেয়েকে নিয়ে আমি কি করি?’
‘মৃত মায়ের হাতের শাখা সিঁদুর দেখে শিশুটি কোন ধর্মের বুঝতে পারলাম। আমি তাকে হিন্দু সমাজে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন দেখি কলেজের দিক থেকে একটা লোক আসছে। আমি তার কাছে শিশুটিকে দিয়ে বলি আজকের রাতটুকু রাখতে। সকাল হলেই আবার নিয়ে যাবো।’
পরের দিন সকালে সেই লোকের কাছে তখনো নাম না পাওয়া সেই শিশুকে ফেরত আনতে যান এরশাদ আলী। তবে সেই পরিবারটি শিশুটি ফেরত দিতে নারাজ। পরিবারটিও হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এরশাদ আলী শিশুটি তাদের জিম্মায় দেন। নাম দেওয়া হয় রাজকুমারী সুন্দরী বালা। এরশাদ আলী বলেন, ‘পরে মেয়েটার বয়স যখন ১৪ বছর হলো তখন আমরা সবাই মিলে একটা ঋষির ঘরে তাকে বিয়ে দিলাম। তার এখন দুই সন্তান।’
কেমন আছেন সুন্দরী বালা
পাঁচ-ছয় বছর বয়সে বুঝতে শেখেন সুন্দরী বালা। ছোট থেকেই শুনতে হয়েছে ‘তোর মা-বাপ কিডা?’ সুন্দরী বালা বলেন, ‘পরে জানলাম যাদের কাছে বড় হলাম তারা আমার মা-বাবাই নন। তখন আমার শুনে খুব কষ্ট লাগতো।’
‘বলতে গেলে স্মৃতিসৌধই আমার বাবা-মার স্মৃতি। আমি যখন এই স্মৃতিসৌধে আসি তখন আমার সেই মা বাবার কথা মনে পড়ে। আমার খুব কষ্ট লাগে। কান্না চলে আসে। মনের দুঃখে আর থাকতে পারি না।’
প্রসঙ্গত, ভৌগোলিক কারণে ১৯৭১ সালে চুকনগর বাজার হয়ে ওঠে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক পয়েন্ট। তিনদিকে নদী ঘেরা চুকনগর থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই ভারত।
সীমানা পেরিয়ে ভারত যেতে পারলেই অন্তত বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটুকু মিলবে। এই আশাতে সীমানা পাড়ি দিতে ১৯৭১ সালের মে মাসে চুকনগর জড়ো হয়েছিল লাখো মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পার হতে আসা সেই মানুষগুলোর ওপরই গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তিন থেকে চার ঘণ্টার লাগাতার হত্যাযজ্ঞে সেদিন ১০ থেকে ১২ হাজার তাজা প্রাণ ঝরে যায়।
খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, ফুলতলা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, দৌলতপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের কাছে আজও দগদগে স্মৃতি বহন করে চলা এক স্থান চুকনগর।