চট্টগ্রাম অফিস : ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে নিয়ম অনুযায়ী জমা রাখতে হয় কিছু সম্পদ। ব্যাংকে জমা দিতে হয় সম্পদের দলিলপত্র। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই দলিল যাচাই করে সম্পদ মূল্যের একটি অংশ দেয় ঋণ হিসেবে। ঋণ নেওয়ার এমন নিয়ম থাকলেও তা মানছে না সব ব্যাংক। এক সম্পদ দেখিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ঘটনা ঘটছে একের পর এক। এমনই এক প্রতিষ্ঠান এইচআর গ্রুপ। এই গ্রুপের তিন কর্ণধার একই পরিবারের। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সম্পদ মূল্যের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন তাঁরা। অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা লোপাট করেছেন ১৩ ব্যাংকের ৯০০ কোটি টাকা। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁদের দু’জন লাপাত্তা। অন্যজন কারাগারে।

এই তিনজন হলেন এইচআর গ্রুপের চেয়ারম্যান আনজুমান আরা বেগম; তাঁর স্বামী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন-উর রশিদ; তাঁদের ছেলে পরিচালক হাসনাইন হারুন। তাঁদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে অর্ধশতাধিক। বিভিন্ন মামলায় রায়ও হয়েছে। ওয়ারেন্ট আছে অন্তত ৬০টি। আনজুমান আরা বেগম ও হারুন-উর রশিদকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। হাসনাইন হারুনকে গত ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মা-বাবা-ছেলের সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রুবাইয়া প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগাং ইস্পাত লিমিটেড ও আমানত স্টিল লিমিটেড। ৩০ কোটি টাকার সম্পদ সিকিউরিটি হিসেবে রেখে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন হারুন-উর রশিদ। সবচেয়ে বেশি মামলা আছে রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও চিটাগাং ইস্পাতের বিরুদ্ধে।

হারুন-উর রশিদ ও তাঁর পরিবারের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েলে। তবে এ প্রতিষ্ঠানের কাছেই ঋণ আছে ১৩ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। ৬০০ কোটি টাকা ঋণের বিষয়ে রয়েছে ৯টি মামলা। তাঁদের আরেক প্রতিষ্ঠান চিটাগাং ইস্পাতের কাছে খেলাপি পাওনা প্রায় ১৮৮ কোটি টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখার ২৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৫ কোটি টাকা। এছাড়া মেসার্স এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস শিপ ব্রেকিংয়ের নামে ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখার ৭৫ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বিষয়ে ডিক্রি প্রদান করেন আদালত। ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে ব্যাংক আল-ফালাহ আগ্রাবাদ শাখার ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখার ৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকার দুটি মামলা বিচারাধীন। সব মিলিয়ে রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও চিটাগাং ইস্পাতের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে ৭৮৮ কোটি টাকা ঋণখেলাপির মামলা হয়েছে। অগ্রণী, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এনসিসি, ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকও মামলা করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এইচআর গ্রুপের অন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ হিসেবে আনলে মোট পাওনা হবে ৯০০ কোটি টাকার বেশি।

এ প্রসঙ্গে জানতে হারুন-উর রশিদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। হাসনাইন হারুন গ্রেপ্তার হওয়ায় হারুন-উর রশিদ ও আনজুমান আরা বেগম আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে এর আগে হারুন-উর রশিদ সমকালকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিপইয়ার্ড ব্যবসায় মন্দা ও করোনার কারণে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসান দিয়েছেন তিনি। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভুলের কারণেও তাঁর ক্ষতি হয়েছে। রুবাইয়া ভেজিটেবলেই প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তবে করোনার আগে সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭০ কোটি টাকা ও জনতা ব্যাংকের ৭৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করেছেন। কিন্তু করোনার কারণে আবারও খেলাপি হয়ে গেছেন তিনি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাসনাইন হারুনও হালিশহর থানা পুলিশের কাছে একই রকম দাবি করেন। তিনি বলেন, কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে বেকায়দায় আছেন তাঁরা। অবস্থা একটু ভালো হলেই ব্যাংকের টাকা দিয়ে দেবেন। তবে তাঁর বাবা ও মা কোথায় আছেন তা পুলিশকে জানাননি হাসনাইন হারুন। হালিশহর থানার ওসি জহির উদ্দিন বলেন, ‘হাসনাইন হারুনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেও তাঁর মা-বাবার অবস্থান সম্পর্কে জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। আমরা তাঁদের খুঁজছি। বিভিন্ন ব্যাংকও তাঁদের খুঁজছে।’ ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার আল জোবায়ের বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক থেকে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর খেলাপি হয়ে যান হারুন-উর রশিদ ও তাঁর পরিবার। আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছি। শুরুতে যোগাযোগ রক্ষা করলেও অনেকদিন ধরে লাপাত্তা তাঁরা।’

আট বছর ধরে তালাবদ্ধ হারুনের প্রতিষ্ঠান: সমকালের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি সেকান্দর হোসাইন জানান, সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ তালাবদ্ধ প্রায় আট বছর ধরে। মাঝে কিছুদিন খুললেও দারোয়ান ছাড়া কারখানায় কেউ নেই। এটিই ব্যবসায়ী হারুনের ঋণ নেওয়ার প্রধান প্রতিষ্ঠান। আশির দশকে জাহাজভাঙা শিল্পের মাধ্যমে তাঁর ব্যবসায় উত্থান। ২০০২ সালে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর ব্যবসা ভালো হলেও পরে ক্রমশ লোকসান দিতে থাকে রুবাইয়া ভেজিটেবল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এ কারখানা বন্ধ করে দেন তিনি।

একের পর এক রায়: সাউথইস্ট ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখার ১৪২ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা ঋণখেলাপির অভিযোগে করা একটি মামলায় রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-উর রশিদ, চেয়ারম্যান আনজুমান আরা বেগম ও পরিচালক হাসনাইন হারুনকে গত ৯ জুন ৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া দেওয়ানি আটকাদেশ কার্যকর করার জন্য অর্থঋণ আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত এ আদেশ দেন। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর এনসিসি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার পৃথক আরেকটি মামলায় মা-বাবা ও ছেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ২৫ কোটি ১৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ঋণখেলাপির মামলায় অর্থঋণ আদালত এ আদেশ দেন। ২০১৪ সালে দায়ের হওয়া চেক প্রতারণার দুটি মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত হন হারুন-উর রশিদ। আদালত একটি মামলায় তাঁকে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫ কোটি টাকা জরিমানা করেন। অন্য মামলায় আদালত তাঁকে এক বছর কারাদণ্ড ও ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন। হুমায়ুন কবির নামে এক ব্যক্তির দায়ের করা মামলায় ২০১৯ সালে একবার গ্রেপ্তার হন হারুন-উর রশিদ। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তাঁকে তখন গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে। তখন জামিনে বের হয়ে কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতপশিল করেন তিনি। কিন্তু ঋণের তুলনায় এটি নগণ্য হলেও কিছু ব্যাংক তাঁকে আবার ঋণ দিয়েছে। এখন নতুন পুরোনো সব ব্যাংকই আছে বেকায়দায়। হাসনাইন হারুনকে চেক প্রতারণার একটি মামলায় ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে হালিশহর থানা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১১টি সাজা পরোয়ানা এবং ২৪টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। তাছাড়া আরও ২৪টি মামলার বিচার চলছে।