গাজী আনোয়ার হোসেন ঃ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের হ্যান্ডলিং শ্রমিকরা দীর্ঘদিন তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত।

তাদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে গত সোমবার বেলা ৩টার সময় স্থলবন্দরের সামনে এক সমাবেশ করেছে বন্দরে কর্মরত হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন ৯২৫ ও ৮৯১ রেজিস্ট্রেশনভুক্ত দুইটি শ্রমিক সংগঠন। দেশের অন্যান্য বন্দরে সরকারি কার্গো হ্যান্ডলিং আইন (ম্যানুয়াল) এ টন প্রতি চার্জ ৬০.২০ টাকা। সেখানে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বেনাপোল স্থলবন্দরে ট্যারিফ সিডিউলের কার্গো হ্যান্ডলিং (ম্যানুয়াল) এর চার্জ টন প্রতি ৪৩.৬৯ টাকা। অন্যান্য স্থলবন্দর হতে বেনাপোল স্থলবন্দর কার্গো হ্যান্ডলিং (ম্যানুয়াল) চার্জ টন প্রতি ১৬.৫১ টাকা কম। এ কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একধরণের অসন্তোষ বিরাজ করে আসছে। এখানকার শ্রমিক সংগঠনের দাবি, অন্যান্য স্থলবন্দরের সাথে সমতা রেখে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং (মানুয়াল) চার্জ টন প্রতি ৬০.২০ টাকা করে হলে বেনাপোল স্থলবন্দরের শ্রমিক অসন্তোষ যেমন রোধ হবে তেমনি সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিসহ বন্দরে কর্মরত শ্রমিকের আর্থিক ও সামাজিক মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে শ্রমিক সংগঠনগুলো অন্য সকল বন্দরের ন্যায় বেনাপোল স্থলবন্দরের চার্জ (ম্যানুয়াল) নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন সময় দাবি উত্থাপন করে আসছেন। যে দাবির সাথে বেনাপোল স্থলবন্দরের সাবেক উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার একমত পোষণ করে অন্যান্য স্থলবন্দরের ন্যায় বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং (ম্যানুয়াল) চার্জ নির্ধারণে এক আলোচনা সভা ডেকেছিলেন এবং তার বিষয়বস্তু বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। যে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) এর কার্যালয়ে। তারিখ-২১.১০.২০২১। বেনাপোল স্থলবন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রাজু আহমেদ জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বেনাপোল স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে থেকে অদ্যবধি এ বন্দর থেকে সরকার প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করে দেশ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন কিন্তু এ বন্দরের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ন্যায্য মজুরি না পেয়ে অর্ধাহারে খুবই নাজুক অবস্থায় জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সেথেকে অদ্যবধি পর্যন্ত এখানে টেন্ডার নামের এক অমানিশার অন্ধকার বন্দর শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। দ্রব্যমূল্যের এ উর্ধ্বগতির বাজারে প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি শ্রমিকদের জীবন জীবিকার মান। প্রতি দুই বছর অন্তর কার্গো হ্যান্ডলিং (ম্যানুয়াল) এর টেন্ডার হওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ পেতে কম মূল্য দিয়ে সিডিউল ফেলায় তাদেরকে ৪৩.৬৯ টাকায় কাজ করতে হচ্ছে। এরমধ্যে থেকে আবার সরকার নিয়ে যাচ্ছে ৪৯.৫০% টাকা। সাথে শ্রমিকদের ভাগ্যে ৫০.৫০% টাকার উপর আরো কর্তণ হচ্ছে ইত্যাদি মাশুল। একারণে বার বার তারা আন্দোলন সংগ্রাম করেও সরকার নির্ধারিত ন্যায্য মজুরি পেতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রীট পিটিশন ও সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আবেদন করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন ৯২৫’র সাধারণ সম্পাদক অহিদুজ্জামান অহিদ বাদি হয়ে এ বন্দরের ১৪০০ শ্রমিকের পক্ষে গত ২৪.১.২০২১ ইং তারিখে ০২.০৯.২০১০ ইং তারিখে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন, যাহার এস.আরও নং- ৩১১-আইন/২০১০/শ্রকম/অধিশাখা-৬/নিমনি-১৮/২০০৯ এবং সর্বশেষ প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন যাহার এসআরও নং ৩২০/আইন/২০১৬ মোতাবেক ৫০.৫০ হারে শ্রমিকগণের ন্যায্য প্রাপ্য বকেয়া মজুরি প্রদান/ বাস্তবায়ন করিবার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন নং-৫৪২২/২০১২ ও সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপীল ২০৮০/২০১৪ দাখিল করেছেন। এসাথে সকল বিষয়াদি উপস্থাপন করে পূণরায় বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি চালাচালি করছেন। সর্বশেষ ১৭ ডিসেম্বর-২০১৯ তারিখে টেন্ডার হয়েছিলো এ বন্দরের হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগের। পরবর্তী টেন্ডার ২১ নভেম্বর-২০১১ হওয়ার কথা থাকলেও হাইকোর্টে রীট পিটিশন ও সুপ্রীম কোটে আপীলের কারণে থমকে আছে টেন্ডার প্রক্রিয়া। শ্রমিকদের দাবি, ট্রেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল রেখেই সরকারি আইনে দেশের অন্যন্য বন্দরের সাথে একযোগে টন প্রতি ৬০.২০ টাকা মজুরি দিলে তারা সন্তোষ প্রকাশ করবেন। বেনাপোল স্থলবন্দর শ্রমিক ইউনিয়নকে দেওয়া বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত, স্মারক নং-১৮.১৫.০০০০.০২২.৬২.০৫৯.১৮.১০, তারিখ ১৩.১.২০২২ এর এক চিটির মাধ্যমে জানা যায়, উপর্যুক্ত বিষয় ও সুত্রসমূহের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ স্থলবন্দরসমূহের মালামাল লোডিং/আনলোডিং এর কাজে নিয়োজিত সাধারণ লোডিং/আনলোডিং শ্রমিকগণের ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগ প্রাপ্য অধিকার বাস্তবায়নে সদা প্রচেষ্ট। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পণ্য হ্যান্ডলিং কাজ সম্পাদনের জন্য সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়না। ঠিকাদারের মাধ্যমে বন্দরে পণ্য লোডিং-আনলোডিং কাজ সম্পন্ন করা হয়। বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা প্রবিধানমালা ২০০৭-এর ১৪(১) নং প্রবিধি অনুযায়ী স্থলবন্দরে মালামাল খালাস বা বোঝাই কাজের জন্য হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এবং ২৮ নং প্রবিধি অনুযায়ী হ্যান্ডলিং ঠিকাদার কর্তৃক নিযুক্ত শ্রমিক দ্বারা বন্দরের মালামাল লোড/আনলোড কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৪(২) নং প্রবিধি অনুযায়ী উক্ত নিয়োগ ও কাজের জন্য শর্তাবলী ঠিকাদারের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস, ২০০৮ অনুসরণে উম্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। টেন্ডারের শর্তানুযায়ী ঠিকাদারগণ স্থলবন্দরসমূহের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে। বেনাপোল স্থলবন্দরে বর্তমানে মেসার্স হোসনে আরা এন্টারপ্রাইজ চুক্তি অনুযায়ী পণ্য হ্যান্ডলিং(ম্যানুয়ালী) এর দায়িত্ব পালন করছে। ঠিকাদার শ্রমিকের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গত ২৪.১০.১৬ খ্রিঃ তারিখের এস.আরও নং-৩২০-আইন/২০১৬ অনুযায়ী টন প্রতি মজুরী পরিশোধ করবে। দেশের প্রচলিত আইন/বিধি/নির্দেশ অনুসরণ করবেন এবং এতদসংক্রান্তে আদালত কর্তৃক কোন আদেশ প্রদত্ত হলে তা পরিপালনীয় হবে। এ কারণে কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবেনা।বেনাপোল স্থলবন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের ১৪০০ পরিবারের এখন সময়ের দাবি, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি। তাদের সন্তান পরিজন নিয়ে তারাও সুখে শান্তিতে সমাজে বসবাস করতে চাই। দেশ উন্নয়ন হচ্ছে, চারিদিকে উন্নয়নের জোয়ার বইছে কিন্তু এখানকার ১৪০০ পরিবারের ভাগ্যে অমানিশার ঘোর অন্ধকার বিরাজ করছে। তারা শুভঙ্করের ফাঁকি দেখতে চায়না। তারা চায় ন্যায্য মজুরি।এ বিষয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন ৮৯১’র সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বেনাপোল দেশের সর্ববৃহত্তম স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার মে. টন পণ্য লোড-আনলোড হয়। যার প্রতিটি পণ্য হ্যান্ডিলিংয়ে এখানকার শ্রমিকরা যতœসহকারে কায়িক পরিশ্রম করে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রেখেছে। অচিরেই তাদের ন্যায্য মজুরির দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে ১৪০০ পরিবারের এ দুটি শ্রমিক সংগঠন থেকে বৃহৎ আন্দোলনসহ আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানান তিনি।