সারাবিশ্ব | তারিখঃ নভেম্বর ৮, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 11143 বার
সারাবিশ্ব ডেস্ক : ভারতের আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ বকেয়া ইস্যুতে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার পর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা গেছে। সম্প্রতি ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, প্রায় ৮৫ কোটি ডলারের বকেয়া নিষ্পত্তির সুরাহা না হলে আদানি পাওয়ার সাতই নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছিল। গত বৃহস্পতিবার বকেয়া না পাওয়ায় একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার কথা জানিয়েছে ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিটি।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি নিউজের পক্ষ থেকে ভারতে আদানির কাছে জানতে চাওয়া হলেও, তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে বাংলাদেশে কোম্পানিটির জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খুদে বার্তায় জানানো হয়, ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ডলার সাত দিনের মধ্যে দিতে হবে এমন কোনো দাবি তারা করেনি।
অন্তবর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে জানান, কে কী বললো তার ওপর ভিত্তি করে নয়, সরকারের যে পেমেন্ট প্ল্যানন (বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনা) রয়েছে, সেই অনুযায়ীই পাওনা পরিশোধ করা হবে। প্রথম থেকেই আদানির সঙ্গে চুক্তিটি বাংলাদেশের অনুকূলে নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
আদানির বিদ্যুৎ পুরোপুরি বন্ধ হতে পারে কি?
সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা বা জ্বালানি খাতের অন্য বিশেষজ্ঞদের কেউই মনে করেন না, আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ সরবরাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের একজন সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলেন, এটা পাওনা আদায়ে চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল।তিনি বলেন, বাংলাদেশ আংশিক পেমেন্ট করবে এবং ভবিষ্যতে বাকি টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে, তাই আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার কথা নয়।
ইতোমধ্যেই আংশিক পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া চলমান বলে জানিয়েছেন সরকারের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
ফাওজুল কবির খান বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব গতিতে পাওনা পরিশোধের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
ক্রমশ পরিশোধের অংকের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে সাড়ে তিন কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। নতুন সরকার অর্থের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে সেপ্টেম্বরে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডলার, অক্টোবরে নয় কোটি ৭০ লাখ ডলার দিয়েছে বলে জানান জ্বালানি উপদেষ্টা।
ভারতের ভূমিকা
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ১২ই আগস্ট মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতে (ক্রস বর্ডার) বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য ভারতের নীতিমালায় সংশোধন আনা হচ্ছে। এর ফলে যে বিদ্যুৎ বিদেশে রপ্তানির কথা ভেবে উৎপাদন করা হয়েছিল তা প্রয়োজনে ভারতের জাতীয় গ্রিডেও যুক্ত করা যাবে এবং দেশের ভেতরেও বিক্রি করা যাবে!
ভারতের বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, আদানি পাওয়ারকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই সংশোধনীটি আনা হয়েছে। অবশ্য সাতই নভেম্বরের সময়সীমার খবর সামনে আসার পর ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আদানি ও বাংলাদেশের মধ্যকার ইস্যুতে দেশটির কোনো ভূমিকা নেই।
তবে, বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম।অধ্যাপক ইমাম বলেন, সরকারিভাবে অস্বীকার করলেও ভারতের স্বার্থ এখানে ইনভলভড্ (জড়িত)। সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও তাদের দেশের বড় কোম্পানির ব্যাপারে তাদের একটা পক্ষপাত থাকার কথা।
এক সাক্ষাৎকারে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ বকেয়া পরিশোধে প্রস্তুত। তারা বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছেন। কিন্তু, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে বাংলাদেশকে জিম্মি হতে দেবো না; ব্ল্যাকমেইল করতে দেবো না।
ভারতের অন্যতম বৃহৎ এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে এখনো ব্যাপক বিরোধিতা ও বিতর্ক রয়েছে। বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ ২৫ বছর মেয়াদী এ চুক্তির মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি। এই বিদ্যুৎ চুক্তিকে দেশের ‘স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে উল্লেখ করে এটি সংশোধন, এমনকি বাতিলেরও দাবি তোলা হচ্ছে।
কীভাবে সামাল দেবে বাংলাদেশ?
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, চলতি বছর গ্রীষ্মকালে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। গত ৩০ শে এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট উৎপাদন করে বাংলাদেশ। যদিও দেশটির উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ।
বিদ্যুৎ বিভাগের গত ১৪ই অক্টোবর হালনাগাদ করা পরিসংখ্যান বলছে, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট।
শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে দেশে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিতভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আদানির বিদ্যুৎ না পেলেও সমস্যা হবে না। কয়লার অভাবে আমাদের কেন্দ্রগুলোই উৎপাদন করতে পারছে না।
বাংলাদেশের ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ সরবরাহ করে আসছিল আদানি পাওয়ার। মেগাওয়াটের হিসাবে যা প্রায় দেড় হাজার। একটি ইউনিটের সরবরাহ বন্ধ থাকায় পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
যে পরিমাণ বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে সেটা কোনো সমস্যা নয় মন্তব্য করে ফাওজুল কবির খান বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে, এর জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সংকটের আশঙ্কার কথা আলোচনা হচ্ছে, সেটি মিডিয়ার তৈরি করা ‘হাইপ'(প্রচারণা) বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এটি বড় কোনো সমস্যা নয়।
তবে, বাংলাদেশের অন্য কোনো সোর্স নেই। ফলে, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিকল্পও নেই, বলছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। শীতে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। এতে খানিকটা স্বস্তির কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।