বিশেষ সংবাদ | তারিখঃ অক্টোবর ২৪, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 1513 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কিছু দিন আগেই এই দলটি তার ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী পালন করেছে। এই দলটির দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই দলের সমর্থক ও ভোটার সংখ্যা দেশের মোট ভোটারের ৩১-৩৩ শতাংশ। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই দলটি দেশের ভোটারদের একটি বড় অংশের পছন্দের ছিল। এরপর দলটি যখন স্বৈরাচারী রূপ পরিগ্রহ করল, তখন তার বড় সংখ্যক সমর্থক দলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন; অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন দলছুট ও সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এ দলে এসে ভেড়ে। গত ১০-১২ বছরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে এই হাইব্রিড নেতারা মিলে দেশের সম্পদ লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। এই সময়কালে তাদের সম্মিলিত সম্পদ লুটের তথ্য এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মতে, এই অঙ্ক ২০০ লাখ হাজার কোটি টাকারও অধিক। মনে রাখা দরকার, এই টাকা চুরি ও পাচারের সাথে কিন্তু এই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী ও সমর্থক জড়িত না। তারা এক ‘ইউটোপিয়ান’ জগতে বসবাস করে গেছে, যেখানে তাদের ধারণা ছিল, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।’ তাদের এই ধারণার সপক্ষে যুক্তিগুলোও তারা পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের ‘গুজব সেল’-এর বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফিরিস্তি থেকে। আওয়ামী লীগ নেতারা উন্নয়নের এসব বয়ান দিয়ে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে গেছে এবং তারাও সে কথা বিশ্বাস করে আত্মতৃপ্তি পেয়েছে। গত জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তৃণমূলের এসব আওয়ামী নেতাকর্মী যদিও বিরাট একটি ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা এখনো পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছে না এবং তাদের বিশ্বাসের জায়গাটা এখনো অক্ষত।
গোপালগঞ্জ জেলা শেখ মুজিবের জন্মস্থান। এখানেই তাকে কবর দেয়া হয়েছে। এ কারণে গোপালগঞ্জের মানুষের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমাগতভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার পর গোপালগঞ্জ জেলাকে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে এসেছে। এই বরাদ্দের পরিমাণ এত বিপুল যে, গোপালগঞ্জ জেলার উন্নয়ন বরাদ্দ পুরা রংপুর বিভাগের সবগুলো জেলার সমষ্টিগত বরাদ্দের চেয়েও বেশি ছিল। এই বরাদ্দের ফলে গোপালগঞ্জ যেমন অবকাঠামোগত দিক দিয়ে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, আঞ্চলিক উন্নয়নের ‘ট্রিকল-ডাউন’ ইফেক্টের কারণে এই জেলার বাসিন্দাদেরও অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতি বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা পার্শ্ববর্তী একটি জেলা সফরে গিয়ে এই উন্নয়ন-বৈষম্য প্রত্যক্ষ করে এসেছেন এবং তার অসন্তোষ সাতক্ষীরার একটি সমাবেশে প্রকাশও করেছেন। অন্যান্য জেলার সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্যের আরেকটি বড় কারণ হলো, আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে, তখন তারা দেশের সব পরিবারের ন্যূনতম একজনকে চাকরি দেয়ার ঘোষণা দিলেও সে ঘোষণা শুধু গোপালগঞ্জ জেলাতেই বাস্তবায়ন করেছে। নন-ক্যাডার পদে, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন সংস্থায় গোপালগঞ্জবাসীদের সংখ্যাগত প্রাধান্য এখন অবিসংবাদিত। এদের উদ্যোগেই দেশের পুলিশ বাহিনী গত ১০-১২ বছর ধরে গণমানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং এদের কারণেই পুলিশের আজকের এই দুর্নাম। এই গোপালি লোকদের জন্যই পুলিশ এখনো তাদের পূর্ব অবস্থানে ফিরে যেতে পারেনি এবং এই গোপালিদের কারণেই আনসার বিদ্রোহের মতো ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে যখন আওয়ামী লীগাররা পলাতক ও আত্মগোপনে, তখন গোপালগঞ্জের মানুষ এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কর্মসূচি পালনের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা শুধু যে কর্মসূচি পালন করছে তাই নয়, তারা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাঙচুর ও সেনাসদস্যদের মারধরের মতো ঔদ্ধত্যও দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানেও পতিত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা নানাভাবে মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা শুরু করছে। এই প্রয়াস প্রথমে লক্ষ করা যায় গত ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকীতে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সফল গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার লজ্জাজনক পলায়নের মাত্র ১০ দিন পর যখন আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী পালানোর পথে, তখন ‘রোকেয়া প্রাচী’ নামক একজন অভিনেত্রী শেখ মুজিবের বাসার সামনে শোক পালনের জন্য উপস্থিত হন। তিনি ও তার অনুগত কিছু তরুণ সেখানে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন। এরপর সেখানে তিনি সমাবেশের চেষ্টা করলে উপস্থিত জনগণ তাদের ধাওয়া দেয়। এ সময়ে উপস্থিত সেনাসদস্যদের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান এবং স্থান ত্যাগ করেন।
এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের একজন মহিলা কর্মী শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনের লক্ষ্যে অশালীন পোশাক পরে একটি কেক হাতে রিকশায় চড়ে যাওয়ার পথে স্থানীয় তরুণদের রোষের মুখে পড়েন। তারা তাকে এ নিয়ে বিদ্রুপ করা শুরু করে এবং তার কেক নষ্ট করে দেয়। বস্তুত আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি বড় অংশই আওয়ামী অনুরক্ত ও আওয়ামী আশীর্বাদপুষ্ট। আওয়ামী সরকার এদেরকে দীর্ঘদিন পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে এবং যোগ্যতা নির্বিশেষে পুরস্কৃত করেছে; এমনকি তাদের জন্য প্রতিবেশী দেশ থেকেও পদকের ব্যবস্থা করেছে। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে এদের প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
সবশেষ ঘটনাটি ঘটে গত অক্টোবর ৫ তারিখে, যখন লালমনিরহাট কালেক্টরেটে চাকরিরত একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তার ফেসবুক পেজে ডক্টর ইউনূসের একটি বক্তব্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করে এবং তাকে হুমকি দিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়। তার এই কাজটি সরকারি চাকরিবিধির সরাসরি লঙ্ঘন। ফলে সরকারের তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘনের কারণে বিভাগীয় মামলা চলছে।
উপরের উদাহরণগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা বর্তমান সরকারকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করা এবং উৎখাতের জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করা থেকে শুরু করে বহির্নোঙরে তেলবাহী জাহাজগুলোতে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমই যে চালাচ্ছে তা নয়, তারা সরকারের ভেতর থেকেও সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এই কাজে তারা ব্যবহার করছে তাদের অনুগত মহিলাদের, যার মধ্যে আছে প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত নারী কর্মকর্তারাও। এরা আওয়ামী লীগের সফ্ট পাওয়ারের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত স্বৈরাচারী সরকার গত ১৫ বছরের অধিক সময়কাল ক্ষমতায় থেকে এরকম বিরূপ দিনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো এদিকে তেমন লক্ষ দেয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করা কর্মকর্তা থেকে শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি কাজ করা নারী কর্মকর্তারা এখনো সরকারের অতিরিক্ত সচিব, সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন। এই মানুষগুলো সরকারে কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামীবিরোধী কর্মকর্তাদের চিহ্নিতকরণসহ তাদের ওএসডি করা, চাকরিচ্যুত করাসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। আমাদের উপদেষ্টারা তাদের কাজের কমফোর্টের জন্য এদেরকে তাদের স্বপদে রাখতে ইচ্ছুক মর্মে জানা যায়। কিন্তু তারা অনুধাবন করছেন না যে, সাপের চেয়েও বিষাক্ত এই মহিলারা কী দুর্ঘটনার পরিকল্পনা করতে পারেন বা করছেন। তাদের অশুভ কাজ করার ক্ষমতার একটি ছোট উদাহরণ হলো লালমনিরহাটের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মি। ঊর্মি ছোট কর্মকর্তা হওয়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ কম, কিন্তু সিনিয়র কর্মকর্তাদের ক্ষমতা আনুপাতিক হারেই অনেক বেশি।
বর্তমান সরকারের উচিত হবে আর কালবিলম্ব না করে আওয়ামী লীগের এই অনুগত নারী কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়া। গত দুই মাসে আওয়ামী লীগ অনুগত বেশ কিছু সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়েছে বা অবসর দেয়া হয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে একজনও নারী কর্মকর্তা নেই। অথচ নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে শেখ হাসিনার অনুগ্রহ লাভের জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলেছে বলে শোনা যায়। আর গোপালগঞ্জের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেশের ৬৪ জেলার একটি জেলা হিসেবে গোপালগঞ্জ জেলার অধিবাসীদের যে কয়টি পদ প্রাপ্য, চাকরিতে থাকা তার অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবিলম্বে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রয়োজন। আর সামনের বছরগুলোতে গোপালগঞ্জ জেলার অতীত বরাদ্দকে বর্তমান/ভবিষ্যৎ বরাদ্দের সাথে সমন্বয় করে অন্যান্য জেলার সাথে একটি সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসা দরকার। এটি সময়সাপেক্ষ বিষয় এবং সে কারণেই এটি এই অর্থবছর থেকেই কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা এখনো অটুট। এদের যেকোনো সাফল্যের জন্য আমরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদেরকে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী দৃশ্যমান কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা হাজার হাজার তরুণ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশের গণমানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন। এই দায়িত্বকে তাদের কোনো চাকরি না; বরং একটি ব্রত হিসেবে নিতে হবে। এই দায়িত্বে অবহেলার বা বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী
সূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত।