রাজনীতি | তারিখঃ আগস্ট ২৮, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 5130 বার
কুষ্টিয়া প্রতিনিধিঃ দেশের রাজনীতিতে আলোচিত নাম জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপ নগরের সন্তান ইনু আটকের খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জেলার মানুষ। সামনে চলে এসেছে তার অনেকে অনিয়মের চিত্র। অনেকে মুখ খুলেছেন। বলছেন বিভিন্ন অনিয়ম ও অত্যাচারের কথা।
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট থেকে দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরাজিত হন। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র দুইবার এলাকায় আসেন এই নেতা। ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনুর সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। তাই সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতারা মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিনের পক্ষে ভোটে নামলে ইনুর নৌকা ডুবে যায়।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে ইনু জেলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িও ভেড়ামারায় হওয়ার সুবাদে দুইজনের মধ্যে ছিল সাপে-নেওলে সম্পর্ক।
গত রবিবার ভেড়ামারা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে এক প্রতিবাদ সভা থেকে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারা ইনুকে কটাক্ষ করে নানা বক্তব্য রাখেন। অশ্রাব্য ভাষায় ইনুকে গালিগালাজও করেন কয়েকজন নেতা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালের আগের তিনটি নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর- ভেড়ামারা) আসন থেকে জাসদ থেকে মশাল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপি প্রার্থীর কাছে জামানত হারান। তবে মহাজোট গঠনের পর ইনুর কপাল খুলে যায়।
একই আসন থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ দলীয় মনোনয়ন চাইলেও ইনুকে আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণে কপাল পুড়ে যায় হানিফের। হানিফকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে পাঠানো হয়। আর সর্বশেষ ৪টি সংসদ নির্বাচনে নৌকায় চড়ে ৩ বার এমপি বনে যান ইনু। এমনকি মন্ত্রীর স্বাদও গ্রহণ করেন।
তবে যে নৌকায় চড়ে ইনু এমপি ও মন্ত্রী হন সেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে বিগত বছরগুলোতে ইনু ও তার দল জাসদের সম্পর্ক মোটেও ভাল যায়নি।
বিশেষ করে সর্বশেষ দুটি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন ইনু। শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে কয়েকবার ইনু উতরে গেলেও এবার ইনুর নৌকা ডুবে যায় হানিফের শিষ্য কামারুলের কাছে। শিষ্যকে দিয়ে ফাঁদ পেতে ধরাশায়ী করেন ইনুকে। ইনু ও জাসদের রাজনীতি কুষ্টিয়া থেকে বিতাড়িত করতে হানিফ উঠেপড়ে ছিলেন। সর্বশেষ দুই বছরে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে হত্যার অভিযোগ ওঠে জাসদ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে চাঁদগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর জাসদের সাথে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ইনুর বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ করে শাস্তি দাবি করেন।
আর এ হত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ করা হয় ইনুর অনুগত ও ডানহাত হিসেবে পরিচিত জেলা জাসদ সভাপতি আব্দুল আলীম স্বপন ও তার ভাই চাঁদগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান তপনের বিরুদ্ধে। ইনু আসামি না হলেও জাসদের জেলা শীর্ষ নেতারা আসামি হয়েছেন। এরপর গত বছরের ২ আগস্ট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সঞ্জয় কুমার হত্যার পর জাসদকে দায়ী করা হয়। এ ঘটনার পর জাসদ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের লোকজন। এসব নিয়ে জাসদ ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আর জোড়া লাগাতে পারেনি ইনু। যার পরিণতি ভোগ করতে হয় সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে।
পূর্বের রাগ ও অভিযান থেকে মাহবুব উল আলম হানিফ রাজনীতির মাঠে ইনুকে ঘায়েল করতে শিষ্য কামারুল আরেফিনকে দাঁড় করিয়ে দেন। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইনুর বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে নামলে বেকায়দায় পড়ে যান ইনু। ঢাকায় বসে কামারুলকে মাঠ থেকে সরাতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত না পেরে হতাশ হন ইনু। নির্বাচনে কামারুল আরেফিনের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে মান অভিযানে আর জেলা মুখী হননি খুব একটা।
জাসদ গণবাহিনীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইনুকে নিয়ে নিজ দল জাসদেও আছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে জাতীয় নেতা কাজী আরেফ হত্যার ঘটনায় দলের অনেকেই মাস্টার মাইন্ড হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন। এছাড়া কুষ্টিয়া অঞ্চলে আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের নায়ক হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন সাধারণ মানুষ। কুষ্টিয়া অঞ্চলে অস্ত্রের রাজনীতি ও চরমপন্থি গ্রুপগুলো একটা সময় ইনু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি তার দলের অনেক-কর্মি এখনো অস্ত্রের রাজনীতি করেন বলেন অভিযোগ আছে।
সর্বশেষ ভেড়ামারা আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন ইনু অনুগতরা।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, ইনু কথায় কথায় পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতেন নেতা-কর্মীদের। জামায়াত-বিএনপির অনেকেই ইনুর সহানুভূতি পেলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া করা হয় তার আমলে।
আলেম বিদ্বেষী ইনুর প্রতি জেলার বড় একটি অংশ চরম ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে হেফাজত ইসলামের নেতারা ইনুর কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
হেফাজত নেতা মুফতি আব্দুল লতিফ বলেন, আলেমদের নিয়ে অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন ইনু। শাপলা চত্বরে আওয়ামী লীগ সরকার যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড ছিল ইনু। তাই তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে ১৫ বছর এমপি থাকাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার একছত্র আধিপত্য ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি তার পরিবারের লোকজন সভাপতি হিসেবে বসিয়েছেন। স্ত্রী আফরোজ হক রিনা ছাড়াও ছেলেকে সভাপতি করেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। টেন্ডার হাট-ঘাট দখলে ছিল ইনুর অনুগতদের।
সোমবার বিকালে ভেড়ামারায় ইনুর নিজ ইউনিয়ন গোলাপনগর এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়।
আতিয়ার রহমান নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন,‘ ইনু ছিলেন চতুর ব্যক্তি। তিনি মানুষের সাথে মুখে মিষ্টি কথা বলে লোকজনকে ভুলিয়ে রাখতেন। তবে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতেন সব সময়। ইনু দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন করতে না পারলেও তার দলের কতিপয় নেতা-কর্মী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। হাসানুল হক ইনুর সম্পদের বিষয়ে বলেন,‘ টানা ৩ মেয়াদে এমপি থাকায় নিজ এলাকা গোলাপনগরে একটি বাড়ি ছাড়া উপজেলার কোথাও তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোন সম্পদ নেই। তবে ঢাকায় তার ও তার ছেলেদের নামে অনেক সম্পদ আছে বলে জানান তিনি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন,‘ ইনু এমপি থাকাকালীন কোনো সুযোগ-সুবিধা আওয়ামী লীগের কাউকেই দেননি। তার দলের ৩ থেকে ৪ জন নেতা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। ইনু তাদের এ সুযোগ করে দিয়েছেন। আর মিরপুর উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী সব কাজের কমিশন ইনুর স্ত্রী আফরোজ হক রিনাকে দিতেন বলে সবাই বলাবালি করে। তবে ইনুর পুরাতন একটি বাড়ি ছাড়া জেলায় কোনো সম্পদ আছে বলে জানা নেই।’
জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মহসিনের সাথে কথা বলতে তার মোবাইলে রিং দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
এছাড়া ভেড়ামারা উপজেলা জাসদের শীর্ষ নেতাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, জাসদ সভাপতি ইনু ভারতে পালিয়ে থাকা হাসিনার প্রধান দোসর। তারা ১৫ বছরে বাংলাদেশকে শোষণ করেছে। তাই ইনু দায় এড়াতে পারে না। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।