বিশেষ সংবাদ | তারিখঃ মে ২৯, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3326 বার
॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥ শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম-আলু, পেঁয়াজসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে চরম ঊর্ধ্বমুখী। কঠিন এ বাজার পরিস্থিতিতে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, বাজার মনিটরিং সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও মুদ্রানীতির কারণে সাধারণ মানুষ। পবিত্র ঈদুল আজহা ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে কঠিন এক গ্যাড়াকলে সাধারণ মানুষ।
দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : দেখার কেউ নেই : আলুর বাম্পার ফলনেও এ বছর এখন আলু ৫৫ টাকা কেজি। একইভাবে এ বছর ভালো পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও সুফল পাচ্ছে না মানুষ। বাড়তে বাড়তে পেঁয়াজের দাম বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৮০-৮৫ টাকা কেজি। কঠিন এ পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। বাড়তি দামে কিনতে বাধ্য হলেও মানুষের মাঝে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। বর্তমানে নতুন সবজি উঠতে শুরু করলেও দাম অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। কাঁচা পেঁপে স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙে কেজি ১২০ টাকা পর্যন্ত ছুঁয়েছে। এছাড়া প্রতি কেজি গোল বেগুনের দাম ১০০ টাকা। বড় বেগুন ১২০ টাকা, লম্বা বেগুন ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপণ্য কাঁচামরিচের দামেও ঝাঁঝ বেড়েছে। প্রতি কেজি কাঁচামরিচের দাম ১৮০ টাকা। পটোলের কেজি ৬০ টাকা, করলা ৮০, বরবটি ৮০, কাঁকরোল, ধুন্দুলের কেজি বাজারভেদে ৮০-৮৫ টাকা। মাঝারি আকারের কলার হালি ৪০ টাকা, ঢেড়শ বাজারভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। ঝিঙার কেজি ৮০ টাকা, কচুরমুখী ১৪০, লাউ প্রতিটি ৬০, চালকুমড়া (জালি) প্রতিটি ধরনভেদে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ৭৫০ গ্রামের বাঁধাকপি ৫০ টাকা। স্বস্তি নেই মাছের বাজারেও। আমদানি করা বড় রসুন ২৪০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি। সোনালি মুরগি বাজারভেদে ৩৯০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি। চাল-ডালের দামও বেড়েছে। কদিন আগে ভোজ্যতেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বাজার অস্থির। যেন দেখার কেউ নেই।
মাছের দাম কমছেই না, গরুর গোশতের তেলেসমাতি শেষ : মাছ-গোশতের দাম কমছেই না। গত রোজার ঈদের পর থেকে গরুর গোশত ৮শ টাকা ছুঁয়েছে। রাজধানীর গোশত বিক্রেতা খলিলের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার গরুর গোশত কমিয়ে এনে যে চমক দেখিয়েছিল, সেটি এখন কেবলই আইওয়াশ ছিল। সেই খলিল কসাই এখন প্রতি কেজি গরুর গোশত ৭৯০ টাকা বিক্রি করছেন। রাজধানীর কারওয়ানবাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের মাছের দাম। বিক্রেতারা বাজারে মাছের সরবরাহ কম বললেও মাছের সরবরাহ ভালোই দেখা গেল। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ২০০-২২০ টাকা, আকারভেদে চাষের পাঙাশ ২০০-২৩০, চাষের শিং ৫০০, চাষের মাগুর ৫৫০ ও চাষের কৈ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। আর আকারভেদে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০, কোরাল ৮০০ থেকে ৮৫০, টেংরা ৬৫০ থেকে ৭০০, বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০, বাইন ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি দেশি কৈ ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকার ওপরে। মাছের এ ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে বাঙালির চিরাচরিত মাছে ভাতে বাঙালির শ্লোক বর্তমানে উঠে গেছে।
এদিকে বাজারে ঊর্ধ্বমুখী গোশতের দামও। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০-২২০ টাকায় পৌঁছেছে। সাধারণ একটি এক-দুই কেজির ব্রয়লার কিনেই বাজারের বাজেট শেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের। এছাড়া সোনালি মুরগি ৩৫০-৩৭০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০-৬৫০, সাদা লেয়ার ২৬০ ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩৩০ টাকা। এদিকে প্রতি কেজি গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি খাসির গোশত ১২০০ টাকায়। স্বস্তির খবর নেই চালের বাজারেও। প্রতি কেজি ভালো চালের দাম গড়ে ৭০-৭৫ টাকার নিচে নেই।
হাত ঘুরলেই কয়েকগুণ বেড়ে যায় পণ্যের দাম
শুধু হাতবদলের মাধ্যমেই সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে ১৩৪ শতাংশ। দেখা গেছে, কৃষকের উৎপাদিত সবজি পাঁচ হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে ছয় দফায় দাম বাড়ে। এতে সবজিভেদে দাম বাড়ছে প্রায় ১৩৪ শতাংশ। এতে সাধারণ কৃষকরা যেমন লাভবান হতে পারছেন না, তেমনি সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে না আসার কারণে অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সবজিভাণ্ডারখ্যাত সীতাকুণ্ড ও শঙ্খতীরের দোহাজারী এলাকার একজন কৃষক যে সবজি বিক্রি করেন ৩০ টাকায়, তা শহরের ভোক্তাদের কিনতে হয় ৭০-৮০ টাকায়। দেখা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় প্রান্তিক সবজির হাট বসে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী বাজারসংলগ্ন শঙ্খ নদীর তীরে। এ হাটে প্রতিদিন আশপাশের কয়েক উপজেলার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে ভিড় জমান। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শতাধিক ব্যবসায়ী প্রতিদিন এখানে সবজি কিনতে আসেন। প্রতিদিন ২০০ পিকআপ, মিনিট্রাকে করে সবজি নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম শহর এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন বাজারে। বাজারটি ঘুরে দেখা গেছে, ভোর ৬টা থেকেই কৃষকরা সবজি বিক্রি করতে হাটে ভিড় করেছেন। দোহাজারী বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, তিনি নিজের কাঁকরোল নিজে বিক্রি করতে পারেননি। মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে তিনি সবজি বিক্রি করেন। তার সামনেই তার কাঁকরোল স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করে দেন ৩০ টাকা কেজি দরে। অথচ তিনি পেয়েছেন কেজিতে ২০ টাকা। কিন্তু উৎপাদন খরচ, হাটে আনার পরিবহন ভাড়া, বাজারের হাসিল সবই দিতে হয়েছে তাকে। কোনো বিনিয়োগ না করেই কেজিতে ১০ টাকা লাভ করলেন ফড়িয়া। একইভাবে এ ফড়িয়া থেকে সবজি কিনে ব্যবসায়ীরা শহরে রওনা হন। দোহাজারী থেকে চট্টগ্রাম শহরে সবজি আনতে প্রতিটি গাড়িতে তার খরচ পড়ে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এতে তিনি যে টাকায় সবজি কিনেছিলেন তার সঙ্গে প্রতি কেজি সবজিতে ২/৩ টাকা করে খরচ যোগ হয়। এই পাইকার নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তদারের কাছে প্রতি কেজি কাঁকরোল বিক্রি করেন ৫০ টাকায়। এরপর আড়তদার কেজিতে ৫ টাকা লাভ করে খুচরা বিক্রেতার কাছে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেন। কৃষক ২০ টাকার শিম দ্বিগুণেরও বেশি দামে সর্বশেষ খুচরা ব্যবসায়ী ভোক্তার কাছে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি করেন। এটি শুধু একটি বাজারের দৃশ্য নয়, এটি সারা দেশের চিত্র। এভাবেই নিয়ন্ত্রণহীন সিন্ডিকেটগুলো নিজেদের মতো করে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে ভোক্তাদের জিম্মি করে।
চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট : দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে
পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট। সুশীল সমাজ এবং সর্বোপরি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন তথ্যে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়টি তুলে ধরে এবং বেশকিছু গ্রেফতার ও পদক্ষেপের কথা জানায়। র্যাব জানায়, তারা ৯টি স্থানে বিভিন্ন পাইকারি কাঁচাবাজার এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তারা বলেছে, সারা দেশের কৃষকের কাছ থেকে ১৫ টাকায় এক কেজি সবজি কেনা হয়। ঢাকায় আসার পর এ সবজি বিক্রি হয় ৬০ টাকা কেজিতে। নিত্যপণ্যের এ অযৌক্তিক-অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে রয়েছে সড়ক-মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিত চাঁদাবাজ চক্র। এছাড়া এর জন্য সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও দায়ী। র্যাব জানায়, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, ইত্তেফাক মোড়, টিটিপাড়া, কাজলা, গাবতলী, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটটি গ্রুপের চাঁদাবাজ চক্রের সক্রিয় ৫১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-২ ও ৩। এ সময় তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের নগদ ১ লাখ ১২ হাজার ৩০৬ টাকা ও রসিদ, লেজার রশ্মির লাইট, ছয়টি জ্যাকেট, চারটি আইডি কার্ড এবং ৪১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। র্যাব রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায়। র্যাব জানায়, পণ্য উৎপাদনের স্থান থেকে পাইকারি বাজারে পরিবহনের সময় দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ধাপে ধাপে চাঁদা আদায় করা হয়। এতে পাইকারি-খুচরার সবজি বাজারে প্রভাব পড়ছে। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। তাদের ভাষায়, রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়িতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা তথাকথিত ইজারাদারদের নির্দেশে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রতি রাতে লাখ টাকা চাঁদা তোলে। তার বিনিময়ে তারা ৬০০-৭০০ টাকা ‘মজুরি’ পায়।
রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতিতে দেশ
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দাম বাড়ার পেছনে অন্যান্য অনেক কারণের মাঝে অর্থনীতিবিদগণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের ভয়াবহ অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতিকেও দায়ী করছেন। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস বা বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের এপ্রিলে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগে মার্চে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও আবারও ১০ শতাংশের ওপরে উঠেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর গত বছরের এপ্রিলে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা দ্রব্যমূল্য নাকি সরকারের এক নম্বর এজেন্ডা মুখে বললেও বাস্তবে তা প্রতিরোধে কোনো প্রতিফলন নেই বলে অর্থনীতিবিদরা জানান। চলতি অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু নানা পদক্ষেপ নিয়েও তা কোনোভাবেই ৯ শতাংশের নিচে নামাতে পারেনি। বরং টানা ২৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বিবিএস যেসব পণ্যমূল্য নিয়ে জরিপ করে, সে তালিকায় খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, চিনিসহ ১২৭টি পণ্য। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত খাতের মধ্যে রয়েছে কেরোসিনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেল, স্বর্ণ, পরিবহন ও যোগাযোগসহ ২৫৬টি পণ্য। জ্বালানি তেল, পরিবহন ভাড়া প্রতি মাসে বাড়ে না আর সোনার দাম সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে না। তাদের জীবনে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো খাদ্যপণ্য, ওষুধ আর চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি। ফলে মূল্যবৃদ্ধির জরিপে প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে তাদের জীবনে দুর্দশা অনেক বেশি। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এখন থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হচ্ছে। এর আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে এ হিসাব করা হতো। ভিত্তি বছর পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হলেও বাস্তবে তা আরো অনেক বেশি বলছেন অর্থনীতিবিদগণ। অন্যদিকে আর এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর বেড়েছে মুরগিসহ পোলট্রি পণ্যের দাম। সব মিলিয়ে জিনিসপত্র বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে সীমিত আয়ের মানুষ অনেকটা না খেয়ে মরে যাবার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
ভোগ্যপণ্যের দামও বাড়ছে হুহু করে
ভোগ্যপণ্যের দাম শুধু পাইকারি পর্যায়েই গত কিছুদিনে বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। সরকারিভাবে মার্কিন ডলারের মূল্য প্রায় সাড়ে ৭ টাকা বাড়ানোর পরপরই বাজারে তার ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে আমদানিকারকরা জানান। ১৩টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। এছাড়া আমদানি ও পরিবহন খরচও বেড়েছে। তাই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডলারের দাম বৃদ্ধির আগে মসলাপণ্য দারুচিনির কেজি ছিল ৩৮০ টাকা। এখন ১০০ টাকা বেড়ে ৪৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর দাম সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ২৬.৩১ শতাংশ। এরপর যে পণ্যটি বেড়েছে সেটি হলো পেঁয়াজ। ভারত সরকার পণ্যটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরও আমদানিকারকরা উচ্চ শুল্কের কারণে দেশটি থেকে পেঁয়াজ আনছেন না। ফলে দেশে পণ্যটির দাম বাড়ছে। হুট করে এখন পেঁয়াজের দাম ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কুরবানির ঈদে জিরার চাহিদা থাকে। ওই হিসাবে জিরার দামও বেড়েছে, পাইকারিতে জিরার কেজি ৫৯০ টাকা, সেটি বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকায়। কেজিতে ২২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যা কুরবানির আগে আরো বাড়বে। একইভাবে অন্যান্য মসলা ও ভোজ্যতেলের দামেও ব্যাপক বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। খাতুনগঞ্জের আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এক লাফে ডলারের দাম সরকারিভাবে প্রায় সাড়ে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া এখন সরকারি নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেও ডলার মিলছে না। ফলে শতভাগ আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের বাজারেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। আর ডলারের দাম বাড়ার কারণে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে এবং আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কীভাবে সামাল দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ
হামিদুল হক থাকেন রাজধানী মিরপুর এলাকায়। কাজ করেন স্থানীয় একটি গার্মেন্টসের অফিস বিভাগে। তিনি জানান, প্রতি বছর সামান্য কিছু বেতন বাড়ে। তাও বায়াররা দাম বাড়াচ্ছে না বলে মালিক বেতন বাড়াতে চান না, কিন্তু প্রতি মাসেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হুহু করে। সাধারণ আলু আমাদের কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়, চিনি ১৬০ টাকায়। কোথায় আছি আমরা। মানুষের কথা প্রশাসন বা সরকার কেউ ভাবছে না।
কঠোরভাবে বাজার তদারকির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুকে কঠোরভাবে বাজার তদারকির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২০ মে বিকেলে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন এ তথ্য জানান। এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকে কঠোরভাবে বলেছেন, বাজার মনিটরিং যেন জোরালোভাবে হয় এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ যেন ঠিক থাকে। বাজারে ভালোভাবে নজর রাখার তাগিদ দিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু কিছু পণ্যের সরবরাহ ঠিক আছে, সংকট না থাকলেও বাজারে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেজন্য কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
অন্যদিকে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সাংবাদিকদের বলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। তাই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার এবং ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, মূল ব্যাপার হচ্ছে দলীয় মদদপুষ্ট প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা অজুহাত দেখিয়ে অতিমুনাফা করছে। আর কথিত রাজনৈতিক নেতারা এগুলো হতে কমিশন পাচ্ছেন। ফলে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের পুষ্টি ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা দেশে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তিনি আরো বলেন, ‘বাজার তদারকি করবে জেলা প্রশাসন বা ভোক্তা অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের আগ্রহও কম, আবার জনবলও সংকট রয়েছে। তারা কিছু জায়গায় যায়, আবার কোথাও যায় না। অতি মুনাফালোভীরা এর সুযোগ নেয়। বাজারের দিকে নজর কম হওয়ায় তারা সিন্ডিকেট করছে। এতে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে।’ সুত্র : সোনার বাংলা।