জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 2544 বার
বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। বদলে যাচ্ছে দেশের পুরানো ভূমি ব্যবস্থাপনা। আনা হয়েছে আধুনিকতা। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনে মানুষের হয়রানি কমেছে। ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজে এনেছে স্বচ্ছতা। ফলে অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় বেড়েছে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের পরিমাণ। এখন যে কেউ দেশ বা বিদেশ থেকে নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজের মালিকানাধীন জমির সর্বশেষ আপডেট জানতে পারছেন। সমাধান করতে পারছেন যে কোনও জটিলতা। পরিশোধ করতে পারছেন বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, রেকর্ড হালনাগাদ তথা নামজারি, রক্ষণাবেক্ষণ, ভূমি রাজস্ব আদায় ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কাজ। জরিপ পরিচালনা, জরিপ পরবর্তী স্বত্বলিপি বা রেকর্ড ও মৌজা ম্যাপ প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও সরবরাহকরণ হচ্ছে সেটেলমেন্ট সংশ্লিষ্ট কাজ। আর জমির দলিলের নিবন্ধন ও সংরক্ষণ রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট কাজ। ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় স্থাপিত সরকারের ডিজিটাল নাগরিক সেবা ইকোসিস্টেমে ভূমি মন্ত্রণালয় নাগরিক ভূমিসেবা অধিকতর কার্যকর ও দক্ষ করতে ‘ম্যানেজমেন্ট’, সেটেলমেন্ট’ এবং ‘রেজিস্ট্রেশন’-কার্যক্রমের ডিজিটাল সিস্টেম সিনক্রোনাইজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে দেশের কিছু মৌজায় ভূমিসেবা সহজীকরণ ও এর মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাইলট আকারে ই-রেজিস্ট্রেশন ও ই-মিউটেশন ব্যবস্থার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে, সাব-রেজিস্ট্রার জমি রেজিস্ট্রেশনের পূর্বে ডিজিটাল রেকর্ডরুম সিস্টেম থেকে জমির রেকর্ড অনলাইনে যাচাই করতে পারবেন। একইভাবে রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজিস্ট্রেশন দলিল ও বিক্রি হওয়া জমির তথ্য ই-মিউটেশন সিস্টেমের মাধ্যমে পেয়ে যাবেন, যার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামপত্তন কার্যক্রম শুরু করা যাবে। এভাবে দেশব্যাপী ই-রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে ই-মিউটেশনের সংযোগ স্থাপিত হলে মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হতে থাকবে। ফলে মামলা ও জাল-জালিয়াতির সুযোগও কমে আসবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই দেশে শুরু হয়েছে ডিজিটাল ভূমি জরিপ। এর মধ্য দিয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্তে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের’ (বিডিএস) পাইলটিং উদ্বোধন করা হয়েছে গত ৩ আগস্ট। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন মাঠে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন ভূমিমন্ত্রী এম. সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
বিডিএস হচ্ছে এমন সিস্টেম যা ২০০ বছরের ভূমি জরিপের চিরচেনা পদ্ধতি বা প্রথাকে পেছনে ফেলে নতুন দিগন্তে প্রবেশ করাতে সহযোগিতা করবে। বিডিএস’র পাইলটিং পর্ব সফলভাবে পুরোপুরি সমাপ্ত করা গেলে এটি হবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত জরিপ। এরপর ভূমি ব্যবস্থাপনায় আর কোনও জরিপ হবে না বলে জানিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়ই চলবে ভূমি জরিপ। একইসঙ্গে সম্পন্ন হবে ভূমির বিদ্যমান অবস্থার মানচিত্র। যেখানে থাকবে না মানুষের কোনও হাত। ড্রোনের মাধ্যমে তোলা ছবি এবং অন্যান্য ফোর্থ জেনারেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করেই চূড়ান্ত হবে জমির অন্যান্য ইনডিকেটর।
শুধু তাই নয়, ভূমি ব্যবস্থাপনায় চালু হয়েছে ‘নাগরিক ভূমিসেবা’। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে প্রায় ৩ লাখ মানুষ ১৬১২২ নম্বরে ফোন করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (https://www.facebook.com/land.gov.bd) কমেন্ট বা মেসেজ (বার্তা) করে ভূমি বিষয়ক সেবা গ্রহণ করেছেন। জাতীয় ভূমিসেবা কলসেন্টার সেবাটি ‘নাগরিক ভূমিসেবা ২৪/৭’ নামে পরিচিত। ডিজিটাল সেবার কারণেই ভূমি অফিসে না গিয়েই ভূমিসেবা গ্রহণ করতে পারছেন দেশের নাগরিক। এতে মানুষের অর্থ-খরচ ও ভোগান্তি অনেকাংশে কমেছে। অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির সুযোগ কমেছে বহুলাংশে। ‘ভূমি অফিসে না এসেই নাগরিক যেন ভূমি সেবা পান এবং একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যেন কাউকে ভূমি অফিসে আসতে না হয়’ – বর্তমান সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশনের এটিই হচ্ছে প্রধান ও অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও ‘নাগরিক ভূমিসেবা ২৪/৭’ ব্যবহার করে ভূমি অধিগ্রহণ, নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর, খাস জমি বন্দোবস্ত, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ভূমি জরিপ ও রেকর্ডরুম, জল মহাল, বালু মহাল, চা বাগান, হাট বাজার ব্যবস্থাপনাসহ আরও বিভিন্ন ধরণের ভূমি সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করা হয় নিয়মিত। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ‘নাগরিক ভূমিসেবা ২৪/৭’ নামে কল সেন্টারটি কার্যক্রম শুরু হয়।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা আনতে ও জাল-জালিয়াতি রোধে জমির খতিয়ানের সঙ্গে পার্সেল ম্যাপ সংযুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে ভূমি অটোমেশন প্রকল্পে ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থা সংযুক্ত করারও নির্দেশ দেন। পার্সেল ম্যাপ হচ্ছে- অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ সংযুক্ত করে দাগভিত্তিক ভূ-সম্পদ ম্যাপ। গত ২৪ আগস্ট ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় ভূমিমন্ত্রী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ নির্দেশনা দেন। একইসঙ্গে সারাদেশে ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমে ম্যানুয়াল দাখিলা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধে ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থার বিধি-বিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমি করও এসেছে অনলাইনে। ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘অনলাইন ভিত্তিক ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার পাইলটিং (১ম পর্যায়)’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সেবা পেতে প্রথমে সেবাপ্রার্থীকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধন অনুমোদনের পর মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে কর পরিশোধ করা যায়। এ জন্য এখন আর ভূমি কর আদায় করতে সেবাপ্রার্থীদের ভূমি অফিসে ছোটাছুটি করতে হয় না। কর আদায়ের এই পুরো পদ্ধতিটিই অনলাইনের আওতায় চলে এসেছে। ভূমি অফিসগুলোতে এখন আর নগদ টাকা লেনদেন হয় না। অবশ্য পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে এ সেবা পেতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য সার্ভার জটিলতার বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের। ভূমি মন্ত্রণালয় বলছে, এই জটিলতাও থাকবে না।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্তে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। আমরা ভূমি অফিসের মানুষের সেই চিরচেনা হয়রানির পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই। ভূমি অফিসে ক্যাশলেস বিষয়টি যাতে মেইনটেইন হয় সেটি চাচ্ছি। মানুষ ইনস্ট্যান্ট যা যা পাওয়ার তা যাতে পেয়ে যায়— এ জন্যই ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হচ্ছে।