নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাষ্ট্র সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। আর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ ২৩ প্রস্তাবনা দিয়েছে অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটস পার্টি (এলডিপি)।

রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের চতুর্থ দফার সংলাপে অংশগ্রহণ শেষে দল দুটির নেতারা ব্রিফিং করেন।

ঢাকার রমনায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শনিবার বিকাল ৩টা থেকে এই সংলাপ শুরু হয়। প্রথমে গণফোরামের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেন।

প্রতিনিধি দলে ছিলেন গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু, কো-চেয়ারম্যান এস এম আলতাফ হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, সদস্য একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিউদ্দিন আবদুল কাদের, মোশতাক আহমেদ ও সুরাইয়া বেগম।

সংলাপ শেষে যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তাফা মহসিন মন্টু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

মন্টু বলেন, ‘সংবিধান, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ড. কামাল হোসেন কথা বলেছেন। আমরা বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি। সিন্ডিকেটকে অবশ্যই ভাঙতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এর থেকে উদ্ধারের জন্য আমাদেরকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’

গণফোরাম অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চায় জানিয়ে মন্টু বলেন, ‘সবাইকে একমত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকারকে রক্ষার স্বার্থে অর্থাৎ আমাদের নিজেদের রক্ষার স্বার্থে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।’

‘অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন করতে হবে। এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে। ভালো লোক নিয়োগ দেওয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনো সমস্যা না হয়।’

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, আমরা কোনো তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি সংস্কার শেষ করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য।’

গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মন্টু আরও বলেন, ‘আমরা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করব। প্রধান উপদেষ্টা যেকোনো বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা চাইবেন। আমরা যেটা উপলব্ধি করব সেটাই পরামর্শ দেব। জনগণের জন্য দরজা খোলা আছে বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন।’

পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষ কোটি টাকা ফেরত আনতে হবে মন্তব্য করে মন্টু বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। সেটা উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সেটা কোনো দলীয় চিন্তা-চেতনা নয়, জাতীয় ঐক্যমতের চিন্তায় এগোতে হবে।’

সংবিধান সংশোধনের জন্য গণফোরাম প্রস্তাব দিয়েছে কি-না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই-একদিনের মধ্যে আলোচনা করে লিখিত আকারে দেব।’

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার আটটি দিবস বাতিল করেছে। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে মন্টু বলেন, ‘জাতীয় দিবস ছাড়া কোনো দিবসই রাখা উচিত না।’

গণফোরাম সরকারকে নির্বাচন ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারসহ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ বেশকিছু ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে বলে জানান দলটির সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের প্রস্তাবগুলো ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমরা সরকার গঠিত কমিশনের বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব কয়েকদিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে দেবো।’

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ ২৩ প্রস্তাব এলডিপির

গণফোরামের পরে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করেন এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে দলটির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। অন্যরা হলেন— এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নূরুল আলম তালুকদার।

বৈঠক শেষে যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন এলডিপির প্রেসিডেন্ট অলি আহমদ। রাষ্ট্র সংস্কার কাজে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অলি আহমদ বলেন, ‘একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় জামায়াতে ইসলামীকে তখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে। তাহলে তাদের কেন নিষিদ্ধ করা হবে না? আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পুলিশ ও প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে। দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে।’

দেশ ও জনগনের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ২৩টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে এলডিপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা সরকারকে আমরা সহযোগিতা করবো। যারা জনগণের টাকা লুট করেছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই টাকা উদ্ধার করে জনগণের কাজে ব্যয় করতে হবে।’

এসময় তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ের লেখা একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করে অলি আহমদ বলেন, সেই বইয়ে লেখা রয়েছে তাজউদ্দীন আহমেদ একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করতে অস্বীকৃতি জানান।’

অলি আহমদ বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় দুই মাস সময় পূর্ণ করেছে। এই সরকারের কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনেক। তবে এখনও মানুষের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কারণ, সংস্কার কর্মকাণ্ডে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই দেশের মানুষকে নিরাশ করা যাবে না। সরকারকে সাহায্য করার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।’

প্রয়োজনে দক্ষ, শিক্ষিত এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে উপদেষ্টাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়ে এলডিপি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘নিয়মিত রাজনীতিতে থাকা অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নিতে বলেছি। আর আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সংস্কার বাস্তবে রূপ দিতে হবে।’