সীমান্তে ‘পুশ ইন’: আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেও ভারত কেন এত নির্বিকার?
- আপডেট: ০৬:৪০:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
- / ১৫৮

বিশেষ প্রতিবেদক : চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভারত হাজার হাজার মানুষকে, যাদের তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে সন্দেহ করছে, গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে—এই তথ্যে এখন দুই দেশ থেকেই বিভিন্ন সূত্রে স্বীকৃতি মিলছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও ভারতীয় নৌবাহিনী আন্দামান সাগরে নামিয়ে দিয়ে মিয়ানমারের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করার খবর পাওয়া গেছে।
ভারতের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার চুক্তি এবং এমনকি নিজের সংবিধান পর্যন্ত উপেক্ষা করে গৃহীত হচ্ছে—এমনটাই বলছেন মানবাধিকার আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এই ঘটনা নতুন নয়, তবে এবার তা বড় পরিসরে, একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে অনুসৃত হচ্ছে।
‘পুশ ইন’: বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাষ্ট্রীয় কৌশল পূর্বে সীমান্তে এমন অনৈতিক ও আইনের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া ‘পুশ ইন’ ঘটনা কখনো কখনো ঘটলেও, এবারে বিষয়টি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এবং সুপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য—দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাট, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, এমনকি কংগ্রেস-শাসিত কর্নাটক থেকেও—বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম নাগরিকদের অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে ধরে এনে পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাঠানো হচ্ছে।
তারপর এই লোকজনদের ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাদের কেউ রাতের অন্ধকারে, কেউবা অস্ত্রের মুখে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এমন বহু ঘটনার বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে।
তাজা উদাহরণ—গত ৩ জুলাই গুজরাটের ভাদোদরা থেকে একটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইটে ২৫০ জন নারী-পুরুষকে উত্তর-পূর্ব ভারতে এনে বিএসএফের হাতে হস্তান্তর করা হয়। তারা কেউ ইতিমধ্যেই, কেউ হয়তো আসন্ন দিনে পুশ ইন-এর শিকার হতে চলেছেন।
দিল্লিভিত্তিক সাউথ এশিয়া হিউম্যান রাইটস ডকুমেন্টেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক রবি নায়ারের ভাষায়, “এটা অনেকটা যেন ভারত সরকার ওই মানুষগুলোকে অপহরণ করে সীমান্তে এনে ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ ফেলে দিচ্ছে।”
অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ নাকি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার অবজ্ঞা?
ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন কিংবা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী নয়—এটি সত্য। তবে ভারতের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে যে, দেশটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রীতিনীতিকে সম্মান করে এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী বোর্ডেও প্রতিনিধিত্ব করে।
প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী নন্দিতা হাকসার মনে করেন, এই পুশ ইন কার্যক্রম ভারতের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ আইনি দায়িত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তার মতে, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রতিটি ব্যক্তির (শুধু নাগরিক নয়) জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত এবং ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ আইনের চোখে সমতার কথা বলে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরাও এই অধিকারের বাইরে নয়।
তাঁর মতে, “যে মুহূর্তে কেউ ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে, বৈধভাবে হোক বা অবৈধভাবে—সেই মুহূর্ত থেকেই তার কিছু মৌলিক অধিকার জন্ম নেয়। কিন্তু এখন ভারত সরকার তাদেরকে সেই ন্যূনতম অধিকারগুলো না দিয়েই জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছে।”
পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা ভারতকে সাহস জোগাচ্ছে?
নন্দিতা হাকসার আরও বলেন, “যেভাবে পশ্চিমা দেশগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক বা অস্ট্রেলিয়া—শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠাচ্ছে বা তৃতীয় দেশে পাঠানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে, তাতে ভারত জানে এই ইস্যুতে তাদের ওপর কোনও আন্তর্জাতিক চাপ আসবে না।”
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র প্লেন বোঝাই করে অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছে, ব্রিটেন বলছে ব্যর্থ আশ্রয়প্রার্থীদের রোয়ান্ডায় পাঠাবে, ডেনমার্ক জানিয়েছে উগান্ডায় পাঠাবে।
সাংবিধানিক দায় ও যাচাই-বাছাইহীন পুশ ইন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর উপ-এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “একটা দেশ তার ভূখণ্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সেটা করতে হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতিনীতি মেনে। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে যাদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের কারো পরিচয় যাচাই না করেই সীমান্তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, “এভাবে পদ্ধতি না মেনে কাজ করার ফলে দেখা যাচ্ছে, ভারত নিজের নাগরিকদেরও ভুল করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পরে ভুল বুঝে আবার ফিরিয়ে আনছে।”
আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যাদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তারা সবাই বাংলাভাষী মুসলিম। মীনাক্ষী গাঙ্গুলির মতে, এটি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ কি না—সেই প্রশ্নও উত্থাপিত হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
‘বার্তা দেওয়ার কৌশল’—সাবেক কূটনীতিকদের ব্যাখ্যা
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর মতে, এই পুশ ইন কার্যক্রম একটি কৌশলগত বার্তা, যা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ভারতীয় অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ।
তিনি বলেন, “আমরা এটা আগেও দেখেছি—যখনই বাংলাদেশের সরকার ভারতের প্রতি অনুকূল নয়, তখনই ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ঠেলে ফেরত পাঠানো হয়। এটা একটা কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল মাত্র।”
তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার সাথে এর যোগসূত্র অস্বীকার করেন এবং বলেন, “নইলে কংগ্রেসশাসিত কর্নাটক থেকেও তো লোকজনকে পাঠানো হতো না!”
‘এন্ট্রি যখন অবৈধ, এক্সিট কীভাবে বৈধ হয়?’—দিল্লির অবস্থান
ভারতের দক্ষিণপন্থি চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্ত বলেন, “যারা বেআইনিভাবে ভারতে ঢুকেছে বা ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকেছে, তারা আবার কীভাবে দেশের আইনের পূর্ণ সুরক্ষা দাবি করতে পারে?”
তাঁর ভাষায়, “জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে যদি কিছু নিয়মভঙ্গ হয়, তাহলে সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এদের এক্সিট শতভাগ নিয়ম মেনে না হলেও সেটি অপরাধ নয়।”
সরকারি নীরবতা এবং স্বীকারোক্তিহীনতা
ভারত সরকার কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পুশ ইন’ কার্যক্রমের কথা স্বীকার করেনি। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গত মে মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের রাজ্য থেকে ৩০৩ জন ‘অবৈধ বিদেশি’কে ১৯৫০ সালের ‘ইমিগ্রান্টস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে এদের ফেরত পাঠানো বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিক্রমে হয়েছে কিনা—তা তিনি বলেননি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালও নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, “যারা নিয়ম মেনে আসেন, তাদের সমস্যা নেই। কিন্তু যারা অবৈধভাবে আসে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে তিনি ‘পুশ ইন’-এর মতো ঘটনার বিষয়ে সব সময়ই নীরব থেকেছেন।
উপসংহার: রাজনৈতিক কৌশল না আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এড়ানো?
সীমান্তে জোরপূর্বক পুশ ইন এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ ও কূটনৈতিক নীতির এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক নীতিমালার অবজ্ঞা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার নামে জাতিগত-ভাষাগত সংখ্যালঘুদের টার্গেট।