বিশেষ প্রতিনিধি : সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধারণা ছিল মূল্যস্ফীতির ধকল কাটাতে সরকার নিশ্চয়ই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একটি সুসংবাদ দেবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার প্রশাসনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য নতুন পে-স্কেল এবং তার আগ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার একটি ঘোষণা অন্তত দেবে। কিন্তু গত মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) ‘এই মুহূর্তে নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা নয়’, জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এমন বক্তব্যের পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে কর্মচারীদের মন বেশি খারাপ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

ওই দিন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী সংসদকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতার কোনও পরিকল্পনা না থাকার কথা জানান।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‌‘সরকার ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল আদেশ জারি করেছে, যা বর্তমানে বলবৎ রয়েছে। অতীতে বেতন স্কেল আদেশে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবছর নির্ধারিত পরিমাণে বেতন বৃদ্ধির সুবিধা ছিল। কিন্তু জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এ মূল বেতনের শতকরা হারে বেতন বৃদ্ধির বিধানের কারণে সরকারি কর্মচারীদের একটি নির্ধারিত হারে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ঘটে, যা সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারীর জীবনমান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে। কিন্তু করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সরকার ‘ফ্যামিলি কার্ডের’ মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রদানের কার্যক্রম চালু করেছে। জনসাধারণের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার সচেষ্ট আছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা প্রদানের কোনও পরিকল্পনা নেই।’

এদিকে স্থায়ী পে-কমিশন গঠনসহ ২৫ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়েনি। এই ২৫ দফার প্রথমেই স্থায়ী পে-কমিশন গঠনসহ কমিশনে কর্মচারী সংগঠনের প্রতিনিধি রাখা এবং নতুন পে-কমিশন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতার দাবি উপস্থাপন করেছেন সংগঠনটির নেতারা।

এর সপক্ষে অনেকটাই সোচ্চার হয়ে উঠেছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এর ব্যতিক্রম নন। ইতোমধ্যে তারা তাদের ২৫ দফা দাবির সমর্থনে জনমত গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন।

সরকারি কর্মচারীদের মন খারাপ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে আমরা কিছুটা মর্মাহত হয়েছি। করোনার কঠিন পরিস্থিতির পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এর প্রভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এ সময় বিদ্যমান বেতনে সংসার চালানো খুবই কঠিন। তাই মহার্ঘ ভাতা ও নতুন পে স্কেল ঘোষণার বিষয়টি ছিল অনেকটাই প্রত্যাশিত। তবে আমরা এখনও আশাবাদী, নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের কর্মচারী দেলোয়ার হোসেন (ছদ্মনাম) বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি সরকার তার প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সরকার এত কঠিন হবে না। সারা দেশেই সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা অনেকটাই অসহায়।’

এদিকে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে তাদের দাবি-সংবলিত প্রচারপত্র। আগামী বছরের শেষে অথবা পরের বছরের প্রথম সপ্তাহে দেশে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই সময়ের মধ্যে আন্দোলনের আড়ালে কোনও প্রকার নাশকতা বা অস্থিরতা সৃষ্টি হয় কিনা, তা নিয়েও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সতর্ক রয়েছে।

জানা গেছে, সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২৫ দফা দাবির প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে। এ বিষয়টি সরকারের বিবেচনায়ও রয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকার বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মদ তোয়াহা জানিয়েছেন, ‘কোনও আন্দোলন নয়, সংগ্রামও নয়, আমরা আমাদের পক্ষের দাবিগুলো উপস্থাপন করেছি মাত্র। এখন এগুলো সরকারের পক্ষে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা সরকারের বিষয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিশ্চয়ই সরকারের সংশ্লিষ্টরা একটি সুসংবাদ আমাদের দেবে।’

তবে অর্থমন্ত্রীর ‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতার কোনও পরিকল্পনা এই মুহূর্তে সরকারের নেই’, এমন বক্তব্য শেষ কথা নয় বলেও মনে করেন তিনি। তোয়াহা জানিয়েছেন, সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সরকার একটা ভালো ঘোষণা দেবে। ‘“এই মুহূর্তে” না হলেও, কিছু সময় পরেই দেবেন, এমন বিশ্বাসই আমরা তার ওপর রাখতে চাই,’ যোগ করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ বলেছে, জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ বাস্তবায়নের পর তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারি কর্মচারীরা আজ দিশেহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রতিটি পণ্যের দাম দুই থেকে তিনগুণ বাড়লেও সাত বছর ধরে পে-স্কেল না দেওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়েনি। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় পে-স্কেলের আগের মতো কমিটি গঠন করে নতুন স্কেল কার্যক্রম চালু করাসহ এই ২৫ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে।