জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ নভেম্বর ৪, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 5935 বার
ডেস্ক রিপোর্ট : মৎস্য বিজ্ঞানীরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বলেশ্বর নদীকে ইলিশের নতুন প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণার সুপারিশ করেছেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বলেশ্বর নদীতে ইলিশের ব্যাপক প্রজননের সম্ভাবনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যে কারণে দেশে এ মুহূর্তে যে চারটি প্রজননকেন্দ্র রয়েছে, তার পাশাপাশি বলেশ্বর নদীকেও ইলিশের প্রজননের জন্য নতুন একটি সংরক্ষিত কেন্দ্র ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বলেশ্বর নদীতে নতুন প্রজনন কেন্দ্র করা হলে সেখান থেকে বছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ বাড়তি পাওয়া যাবে।
গবেষণায় কী দেখা গেছে?
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চলে ইনস্টিটিউট এই গবেষণাটি চালিয়েছে। বলেশ্বর নদী মূলত দক্ষিণাঞ্চলীয় বাগেরহাট, পিরোজপুর এবং বরগুনা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
বলেশ্বর নদীর মোহনায় মিশেছে বিষখালী, পায়রা, আন্ধারমানিক ও লতাচাপলী নদী। এর সঙ্গে সুন্দরবনের ভোলা নদী, সুপতি খাল, দুধমুখী খাল এবং ছোট কটকা খাল সংযুক্ত। মূলত এসব অঞ্চলজুড়ে গবেষণাটি চালানো হয়েছে।
মাহমুদ বলেছেন, গবেষণায় তিনটি বিষয় দেখতে পেয়েছেন তারা। প্রথমত, গবেষণা চলাকালে ওই অঞ্চলে প্রজননক্ষম ইলিশের আধিক্য ছিল। দ্বিতীয়ত, সেখানে ইলিশের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। এর মানে হচ্ছে, সাগর থেকে ইলিশ যখন ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে, মানে উজানে আসে তখন নদীর যে প্ল্যাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায়, বলেশ্বর নদীর মোহনায় তার প্রাচুর্য ছিল।
এ ছাড়া, গবেষণা চলাকালে গবেষকেরা ওই অঞ্চলে লার্ভি অর্থাৎ ডিম ফুটে বেরুনো বাচ্চা ইলিশ এবং জাটকাও সেখানে প্রচুর পরিমাণে ছিল। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এর আগে যে চারটি ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র করা হয়েছে, তার সাথে এই এলাকার জলজ পরিবেশ এবং মাছের ডিম ছাড়ার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।
এসব কারণে এখন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মনে করে, বলেশ্বর নদী ও মোহনা অঞ্চল ইলিশের একটি সম্ভাবনাময় প্রজননক্ষেত্র। সে জন্য বলেশ্বর নদীর প্রায় ৫০ কিলেমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় সাড়ে ৩০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন প্রজননকেন্দ্র করার প্রস্তাব করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, তাদের পাঠানো সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বছরে আরো ৫০ হাজার মেট্রিক টন বাড়বে, যার আর্থিক মূল্য ২৬৪ কোটি টাকা। এতে ইলিশের উৎপাদন বছরে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টনের মতো হওয়ার আশা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এ মুহূর্তে দেশে মোট মাছের উৎপাদনের ১২ দশমিক ২১ শতাংশ ইলিশ, জিডিপিতে যার অবদান বছরে এক শতাংশ। মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, আগের ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন ৭৫ শতাংশ বেড়েছে।
প্রজনন কেন্দ্র এবং অভয়াশ্রম
ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র।
বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে।
এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।
মাহমুদ বলেছেন, যে ছয়টি নদী এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব জায়গায় ইলিশের ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও এর অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম।
এ ছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা। এসব অভয়াশ্রমে বছরে নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ও জাটকাসহ সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। এই সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকবে। এর লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সরকার বলছে, ওই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। একটি মা ইলিশ চার থেকে পাঁচ লাখ ডিম ছাড়ে।
১০ দফা সুপারিশে কী বলা হয়েছে
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে যে ১০টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, নদ-নদী এবং সাগর থেকে আগামী দুই-তিন বছর পর্যন্ত ইলিশ আহরণের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া। এ ছাড়া মার্চ-এপ্রিল মাসে জাটকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি ইলিশকে তার জীবনচক্রে অন্তত একবার ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি জাল এবং জেলে নৌকা ডিজিটাল ট্যাগিংয়ের আওতায় আনা এবং মৌসুমে মাছ ধরা জালের ফাঁসের আকার সাড়ে ছয় সেন্টিমিটারের কম হতে পারবে না। এ ছাড়া ইলিশ যেহেতু একেক নদীতে একেক সময় ডিম পাড়ে, সে কারণে যখন যে নদীতে ডিম ছাড়বে ইলিশ, সে সময় অনুযায়ী ওই নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। দেশে ইলিশের মজুত ও আহরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের পাওয়ার ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।
সুত্র—বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।