বিল্লাল হোসেন, রাজগঞ্জ : যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম বাসুদেবপুর। এই বাসুদেবপুর গ্রামকে নার্সারীর রাজধানী বলা হয়। বাসুদেবপুর বাজারটি পুরাতন একটি ছোট বাজার হলেও এখন নার্সারীর বাজার হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এই বাজারে নার্সারীর চারা বিক্রয়ের জন্য ও প্রদর্শনী স্টল রয়েছে প্রায় এক’শর মতো।

প্রতিদিন এসব দোকান ও নার্সারী থেকে লাখ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিক্রয় হয়ে থাকে। সারা বছর এই বাসুদেবপুর থেকে ফলজ, বনজ, মসলা, ঔষধি ও ফুলের চারা বিক্রি হয় প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি। নার্সারীর ব্যবসা করে এলাকার মানুষের ভাগ্য যেমনি বদলে গেছে। তেমনি এলাকার মানুষের বাড়ী-গাড়ী হয়েছে। নার্সারীর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বাসুদেবপুর বাজারের উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন হওয়ায় এলাকায় উন্নয়নের বৈপ্লাবিক পরিবর্তন ঘটেছে।

সরেজমিন বাসুদেবপুর গ্রামে যেয়ে দেখা যায়, সারা গ্রাম ব্যাপী গড়ে উঠেছে বহু নার্সারীর বাগান। সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা দুরহ ব্যাপার। আর বাসুদেবপুর বাজারে দেখা গেছে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক নার্সারীর দোকান। সে সব দোকানে সাজানো রয়েছে রকমারী গাছ-গাছালির চারা। রমরমা চারা সাজিয়ে বসে আছে নানা বয়সের চারার ব্যাপারী। আরও দেখা মিলেছে দুর-দুরন্ত থেকে আসা বহু চারা ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের। ওই সব ক্রেতারা ও ব্যবসায়ীরা ট্রাক, পিকআপ, আলমসাধু, ভ্যানগাড়ীতে করে দুর-দুরন্তের মোকামে চারা বহনের জন্য চারা বোঝাই করছেন।

সারা বাজারটি দেখে মনে হয়েছে এ যেনো এক চারার রাজ্য। প্রবীণ নার্সারী ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ্্ নার্সারীর মালিক কুদরত আলী গাজী জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এই নার্সারীর ব্যবসা করছেন। এই ব্যবসাতেই তার ভাগ্য বদল হয়েছে। এর আগে তিনি বাঁশের ব্যবসা করতেন। কিন্তু নার্সারীর চারা ব্যবসায় লাভ বেশি তাই, বাঁশের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নার্সারীর ব্যবসা করছেন।

তার ১৪ বিঘা নার্সারীতে উৎপাদিত চারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বারি-৪, বারি-১১, গৌরমতী, কিউজয়, কাটিমন, ব্যানানা ম্যাঙ্গ, সূর্যডিম, ব্লাক স্টোন, হিমসাগর, লেংড়া, আমরূপালী, হাড়ীভাঙ্গা, চায়নাড্রপ, থাইড্রপ, প্রভৃতি আমের চারা, লিচুবোম্বাই, চায়না-২, চায়না-৩, মোজাফ্ফার, বেদানা, লিচু, দেশি বোম্বাই প্রভৃতি, বিভিন্ন জাতের পেয়ারা, বাতাবি লেবু, কাগজী লেবু, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন, জলপাই, কামরাঙ্গা, ছবেদা, জামরুল, কাঁঠাল, কদবেল, আতা, নেওয়াফল, শরীফা, নারিকেল, রামবুতান, সুপারী, লটকন, করমোচা, তেঁতুল, মিষ্টি তেঁতুল, গাব, আমড়া, পেঁপে, প্রভৃতি, দেশি-বিদেশি ফল, বনজ গাছের চারা মেহগনি, লম্বু, রেন্টি, কড়াই, সেগুন, নিম, নিভুত, প্রভৃতি, চুইঝাল গাছের চারা রয়েছে।

রয়েছে- হাসনাহেনা, কৃষ্ণচুড়া, গোলাপ, প্রভৃতি ফুলের চারা। এসব নার্সারী থেকে উৎপাদিত চারা। তিনি বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকার চারা বিক্রি করে থাকেন। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে প্রায় ৫লাখ টাকা আয় হয় বলে তিনি দাবী করেন।

মায়ের দোয়া নার্সারীর মালিক খন্দকার বাবুল হোসেন জানান, তার প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে নার্সারী রয়েছে। বিগত করোনার বছর ২০২০-২১ সালে তিনি ২৬ লাখ টাকা ও তার পরের বছর তিনি ২২ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। এ বছর ২৫-৩০ লাখ টাকার উপরে বিক্রি হবে বলে তিনি আশাবাদি।

তিনি জানান, তার নার্সারীতে উৎপাদিত চারার মধ্যে এবার লিচুর চারা বিক্রি করেছেন প্রায় ১৫ লাখ টাকার মতোন। দিনাজপুরে এবার তিনি ৩৮০ টাকা দরে ১৪ হাজার লিচুর চারা বিক্রি করেছেন। বাসুদেবপুর নার্সারী ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আল্লাহর দান নার্সারীর মালিক আলহাজ মোশাররফ হোসেন এবং সাধারন সম্পাদক ভাই ভাই নার্সারীর মালিক রুহুল আমিন বলেন, আমাদের এলাকায় কৃষি আবাদের মধ্যে সর্ববৃহৎ আবাদ হলো নার্সারীর চারা উৎপাদন।

এসব বেচা-বিক্রির জন্য ছোট-বড় প্রায় শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে বাসুদেবপুর বাজারে। এর মধ্যে শফিকুল এগ্রো নার্সারী, বিশ্বাস, নার্সারী, জননী নার্সারী, দুবাই-বাংলা নার্সারী, পুরাতন নার্সারী, সততা নার্সারী, তরফদার নার্সারী, গাজী নার্সারী, তানিয়া নার্সারী, হাজিরা নার্সারী, আকাশ নার্সারী, আশিক নার্সারী, মীর নার্সারী, সাগর নার্সারী, দেবজিৎ নার্সারী, বন্ধু নার্সারী, শফিকুল নার্সারী, এনামুল নার্সারী, মা নার্সারী, আব্দুল্লাহ নার্সারীসহ আরও কয়েকটি নার্সারী বড় বলে তিনি জানান।

বিশ্বাস নার্সারীর মালিক সাধন কুমার বিশ্বাস বলেন, বাসুদেবপুর গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে নার্সারীর চারা উৎপাদন করা হয়। এই চারা উৎপাদন ও বেচা-বিক্রির কাজে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং অনেকের বেকারত্ব দুর হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, এই চারা স্থানীয় চাহিদা মোতাবেক বেচা-বিক্রির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলাতে ব্যবসাদের কাছে পাইকারি বিক্রয় করা হয়। বছরে এই বাসুদেবপুর গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কোটিরও বেশি টাকার চারা বিক্রয় হয় বলে তিনি ধারনা করছেন।

স্থানীয় উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, আমরা সব সময় নার্সারীর সাথে সম্পৃক্ত কৃষকদের পাশে আছি এবং নিয়মিত খোঁজ খবর নিয়ে থাকি। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বলা হয়েছে, চারা উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষনসহ নার্সারী পরিচর্যার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তারা। আমরা কৃষকের পাশে আছি।